স্পর্ধা একটি অতি বিশিষ্ট পদার্থ। দৈর্ঘ্য প্রস্থ ঘনত্ব উচ্চতা সবই ইহার আছে, শুধু স্থিতিস্থাপকতা নাই। যত দূর ইচ্ছা ইহাকে টানিয়া লম্বা করা যায় না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা সহকারে ব্যবহার না করিলে ইহার সব কয়টি মাত্রাই বিনষ্ট হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় এই তথ্য জানেন না। সুতরাং নিজের শাসনদণ্ডের মহিমা টানিয়া লম্বা করিতে করিতে এক বিপজ্জনক ভঙ্গুর বিন্দুতে তিনি লইয়া যাইতেছেন। তাঁহার ক্ষমতাস্পর্ধার একটিই কেন্দ্রীয় নির্ধারক। তিনি কাহাকে পছন্দ করেন, কাহাকে করেন না। তদনুযায়ী স্থির হয়, তিনি কাহাকে শাস্তি দিবেন, কাহাকে পুরস্কৃত করিবেন। তাঁহার এই পছন্দের তালিকা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মানুষের জানা নাই, থাকিবার কথাও নয়। তাই প্রশাসনিক কাজে বার বার ‘গলদ’ ঘটিয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রী প্রবল কশাঘাতে প্রশাসনকে তাঁহার পছন্দের ঘেরাটোপে ফিরাইয়া আনেন। এই ধারা চার বৎসর ধরিয়া চলিতেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবত বুঝিতেছেন না যে, তাঁহার প্রশাসনের স্থিতিস্থাপকতাও অশেষ নহে। তাহাকে যে বিন্দুতে টানিয়া আনা হইতেছে, সেখান হইতে হুড়মুড়াইয়া ভাঙিয়া পড়িবার সম্ভাবনা সমূহ। এক বার তাহা ভাঙিয়া পড়িলে রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ও তাঁহার অতুল ক্ষমতাও অক্ষত থাকিবে(ন) না।
যে কনস্টেবল ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহাস্পদ মেয়রের ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিরুদ্ধে ‘ভুল করিয়া’ পদক্ষেপ লইয়াছিলেন, তাঁহার সম্বন্ধে পুলিশ ও প্রশাসন এখন দ্রুত মতামত পাল্টাইতে ব্যস্ত। শুক্রবার সকলেই ভাবিয়াছিলেন, কনস্টেবল ঠিক কাজ করিয়াছেন। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মেয়েটিকে ‘বাচ্চা’ বলিয়া কনস্টেবলকেই অপরাধী প্রতিপন্ন করিয়া দিতেই কর্তারা নড়িয়া-চড়িয়া অবস্থান পরিবর্তন শুরু করিলেন। বার বার একই ঘটনা। সাধারণ পুলিশকর্মী রাজ্য জুড়িয়া অকারণে লাঞ্ছিত বা ভর্ৎসিত হইতেছেন, কেননা উচ্চকর্তারা হীরকদেশ-এর রীতিতে কেবলই ‘ঠিক ঠিক’ বলিতে ব্যস্ত। অথচ এই ‘ঠিক ঠিক’-এর উপরিতলটিই একমাত্র সত্য নহে। তাহার নিম্নে একটি গভীরতর তল আছে, যেখানে ন্যায় বা নীতির স্থান প্রথা বা রীতির অপেক্ষা লঘু নহে। অন্যায় ভর্ৎসনা ও অন্যায় শাস্তিতে সেই নিম্নতলে এই মুহূর্তে যে অসন্তোষের ছায়া, তাহা বাড়িয়া অকস্মাৎ যদি অন্ধকার তিমিরে পরিণত হয়, কোনও কর্তা সেই নৈরাজ্য সামলাইতে পারিবেন না। বাস্তবিক, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সমস্যা যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হন, দ্বিতীয় সমস্যা তাঁহার স্নেহদৃষ্টি-ভিক্ষাকারী প্রশাসনিক মহল। তাঁহারা যদি মেরুদণ্ড সোজা করিয়া নেত্রীর ক্ষমতার উদ্ভ্রান্ত উন্নাসিকতাকে কিয়দংশেও প্রশমিত করিতে পারিতেন, তাঁহাদেরই আখেরে মঙ্গল হইত।
শুক্রবারের ঘটনা লইয়া মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করিয়াছেন বিধানসভায়। বিষয়টি লক্ষণীয়। গত চার বৎসরে কত বার মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় অর্থপূর্ণ বক্তব্য পেশ করিয়াছেন, গুনিতে দুই আঙুলের কড়ও লাগিবে না। অর্থাৎ, এ বারের ঘটনাটি তাঁহার দৃষ্টিতে এতই বিশিষ্ট। সংশ্লিষ্ট নেতার সহিত ঘনিষ্ঠতাই বিশিষ্টতার পরিমাপ স্থির করিয়াছে। গণতান্ত্রিক শাসনের মঞ্চকে এই ভাবে সোজাসুজি অগণতন্ত্রের প্রদর্শনী করিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাস তৈরি করিতেছেন। ঠিকই, প্রেক্ষিত ছাড়া ইতিহাসের উচ্চবিন্দু তৈরি হয় না। বিগত কয়েক দশকের নিরন্তর স্পর্ধাতন্ত্রের আরাধনা ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তৈরি হন নাই। তবে কিনা, উচ্চবিন্দুর ধর্মই নিম্নগামিতা। সেটুকুই আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy