Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

অন্য কোথা

ব্রহ্মাণ্ডের একটি কোণে হঠাৎ আগুন-ফুলকির মতো এক দিন জ্বলিয়া উঠিল বুদ্ধির শিখা, কয়েক মিনিটের জন্য। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যই। কেননা, তাহার পরই ব্রহ্মাণ্ডের সেই কোণটিতে কমিতে লাগিল প্রাকৃতিক উষ্ণতা, নিবিয়া আসিল প্রাণ, এবং শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি বলিয়া যাহা কিছুর উদ্ভব হইয়াছিল, সবটুকু, নিঃশেষে ধ্বংস হইল।

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০১:২৮
Share: Save:

ব্রহ্মাণ্ডের একটি কোণে হঠাৎ আগুন-ফুলকির মতো এক দিন জ্বলিয়া উঠিল বুদ্ধির শিখা, কয়েক মিনিটের জন্য। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যই। কেননা, তাহার পরই ব্রহ্মাণ্ডের সেই কোণটিতে কমিতে লাগিল প্রাকৃতিক উষ্ণতা, নিবিয়া আসিল প্রাণ, এবং শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি বলিয়া যাহা কিছুর উদ্ভব হইয়াছিল, সবটুকু, নিঃশেষে ধ্বংস হইল। সেই কয়েকটি মিনিটের আগেও ছিল না, ওই ক্ষণিকের অবসানেও বিশ্বভুবনে আর থাকিল না মানুষের সেই শতগৌরবের ধন: যাহার নাম বুদ্ধিবৃত্তি বা ইনটেলেক্ট। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চিরায়ত অস্তিত্বের প্রেক্ষিতে এ ভাবেই মানুষকে ও মানুষের অহংমুগ্ধ ধ্যানধারণাগুলিকে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন দার্শনিক নিট্শে। এত তর্ক, বিতর্ক, ঈর্ষা, দ্বেষ, মারপিট, কূটকচালি সকলই হাস্যকর রকমের মৌহূর্তিক, সুতরাং তাঁহার সিদ্ধান্ত: সত্যমিথ্যা শুভাশুভ সকলই চূড়ান্ত অর্থহীন ও তুচ্ছ, ছেলেমানুষির নামান্তর। নিট্শের দর্শন ও নৈতিকতা লইয়া অনেক আলোচনা গবেষণা হইয়াছে, তাহার জটিলতায় না ঢুকিলেও চলিবে। কিন্তু তাঁহার বিবরণ হইতে যে ছবিটি উঠিয়া আসে, তাহা একটি ভাবনায় ঠেলিয়া দেয়। প্রাণ এতখানি ক্ষণিক বলিয়াই কি মানুষের মধ্যে তাহার নিজের মতো আরও কিছু প্রাণ এই ব্রহ্মাণ্ডে খুঁজিয়া বাহির করিবার এত আকুল চেষ্টা? নিজের সমস্ত অস্থায়িত্বকে অতিক্রম করিবার প্রয়াসে নিজ-সম অস্তিত্বের এই মরণপণ সন্ধান? মৃত্যুহীন প্রাণ বিশ্বভুবনে বহাইয়া দিবার জন্যই কি মনুষ্যসৃষ্ট বিজ্ঞান প্রথমাবধি এত প্রবল বহির্মুখী, মঙ্গলগ্রহের জল কিংবা অন্য গ্রহের জীবের আশায় এই নাছোড় আগ্রহ?

অতি সম্প্রতি অন্য এক সৌরজগতে একটি গ্রহ আবিষ্কৃত হইয়াছে, যাহা আকারে-প্রকারে পৃথিবীর সমতুল্য। যে ‘সূর্য’-র চারিপাশে তাহা ঘূর্ণ্যমান, নাম তাহার কেপলার ১৮৬, পৃথিবী হইতে পাঁচশত আলোকবর্ষ দূরে। এমনই সেই গ্রহের বৈশিষ্ট্যসমূহ, তাপমান যে স্তরের, তাহাতে তরল জল থাকিবার সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। এবং জল মানেই যখন জীবন, তখন প্রাণ-অস্তিত্বের সম্ভাব্যতাও উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসে। এত দিন পর্যন্ত মহাকাশের যে সকল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান হইয়াছে, অধিকাংশই অত্যধিক গ্যাসীয় কিংবা পাথুরে। এই বিশেষ গ্রহটি লইয়া তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা-র বিজ্ঞানীরা এই মূহূর্তে রীতিমতো উৎসাহিত, উত্তেজিত।

এই উৎসাহ কেবল মর্মস্পর্শী নহে, মর্মদর্শীও বটে। জগৎ দুঃখময় জানিয়াও যে মানুষ জগৎ-পারাবারের তীর আঁকড়াইয়া থাকিতে চায়, বিদ্বেষবিষ-দীর্ণ দুনিয়াতেও যে প্রতি মুহূর্তে শত সন্তান জন্ম লয়, তাহার মধ্যে যে অবোধ আত্মপ্রবঞ্চনা, ব্রহ্মাণ্ড জুড়িয়া এই প্রাণসন্ধানের মধ্যেও কি তাহার ছাপ নাই? কোন সেই বায়ুমণ্ডল যাহা জল ধারণ করিতে পারে, এবং কোন সেই জলমণ্ডল যাহা প্রাণ লালন করিতে পারে, অক্ষরে অক্ষরে শুদ্ধ ভাবে জানিতে পারিলেই বা পৃথিবীর ঠিকানায় যাহাদের বাস, তাহাদের কী এবং কতখানি করিবার আছে? সত্যই যদি অন্যত্র প্রাণ থাকে, তবে কি পরস্পরের মধ্যে সংযোগস্থাপনা হইবে? পাঁচশত আলোকবর্ষ দূরত্ব সত্ত্বেও কি নোট চালাচালি সম্ভব হইবে? তবু মানুষ জানিতে চাহে, জানিবার জন্যই। জানা জরুরি, কেননা এই পৃথিবীর আলো যে দিন চিরকালের জন্য নিবিবে খানিক দিনদুনিয়ার নিয়মে, খানিক মানুষের স্বকৃতকর্মফলে সে দিন মহাবিশ্বের অন্য কোন কোণে সে অর্পণ করিয়া যাইবে এই ভুবনের ভার, তাহা নিশ্চিত করিবার জন্যই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE