Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

অন্যের শাস্তি নয়, নিজের সুরক্ষা চান মেয়েরা

৪৯৮এ ধারা আবার বিতর্কের কেন্দ্রে। এই ধারার অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু আইনের ধার কমে গেলে মেয়েরা আরও বিপন্ন হবেন না তো? শাশ্বতী ঘোষ।আবার ৪৯৮এ ধারার ‘অপব্যবহার’কে ‘নিয়ন্ত্রণে আনতে’ সচেষ্ট সুপ্রিম কোর্ট। পণ-জনিত অভিযোগে অর্নেশ কুমার বনাম বিহার সরকার মামলায় রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি চন্দ্রমৌলি প্রসাদ ও পিনাকী ঘোষ বলেছেন, এফ আই আর-এ নাম থাকলেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না কেন গ্রেফতারের প্রয়োজন, তা জানিয়ে অভিযোগ দায়েরের দু’সপ্তাহের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি পেলে তবেই গ্রেফতার করা যাবে।

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

আবার ৪৯৮এ ধারার ‘অপব্যবহার’কে ‘নিয়ন্ত্রণে আনতে’ সচেষ্ট সুপ্রিম কোর্ট। পণ-জনিত অভিযোগে অর্নেশ কুমার বনাম বিহার সরকার মামলায় রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি চন্দ্রমৌলি প্রসাদ ও পিনাকী ঘোষ বলেছেন, এফ আই আর-এ নাম থাকলেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না কেন গ্রেফতারের প্রয়োজন, তা জানিয়ে অভিযোগ দায়েরের দু’সপ্তাহের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি পেলে তবেই গ্রেফতার করা যাবে। এই আইনের ‘অপব্যবহার’ প্রমাণ করতে যে-ভাষা এবং পরিসংখ্যান রায়ে ব্যবহার হয়েছে, আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও হয়তো তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। যেমন, বলা হয়েছে, ‘সুরক্ষা বেষ্টনী নয়, অসহিষ্ণু গৃহবধূরা এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এই ধারা স্বামী ও স্বামীর দিকের আত্মীয়স্বজনকে গ্রেফতার করিয়ে অপদস্থ করার সহজতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, সদ্য-প্রকাশিত জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে পণের জন্য মারা গেছেন ৮০৮৩ জন গৃহবধূ, তা-ও এর মধ্যে পণের চাপে আত্মহত্যাকে ধরা হয়নি। অর্থাত্‌, প্রতিদিন সারা ভারতে গড়ে কমপক্ষে ২২ জন মেয়ে পারিবারিক হিংসার শিকার হয়ে মারা যাচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, এই রায় ২০১২ সালের জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর তথ্য দিয়ে বলছে, এই ধারায় ১,৯৭,৭৬২ জন গ্রেফতার হয়েছিলেন, যা সারা দেশে সব ধরনের অপরাধের গ্রেফতারের ৬ শতাংশ, এবং তার মধ্যে ৪৭,৯৫১ জন হচ্ছেন মহিলা, মানে শাশুড়ি-ননদ প্রভৃতি। পুলিশ চার্জশিট দেয় ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রে, কিন্তু শাস্তিদানের হার ১৫ শতাংশ। বাকি যে ৩,৭২,৭০৬ বকেয়া মামলা রয়েছে, তার মধ্যে ৩,১৭,০০০ মামলায় অভিযুক্ত হয়তো বা খালাস পেয়ে যাবে। ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রে চার্জশিট দিয়েছে, অর্থাত্‌ পুলিশ তদন্ত করে অভিযোগের সারবত্তা পেয়েছে। এখানে প্রশ্ন হল, তারা যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে মামলার তদন্ত করেনি, সাক্ষ্য সংগ্রহ করেনি বলে অভিযুক্ত খালাস হয়ে যাচ্ছে না, তারই বা প্রমাণ কী? ধর্ষণের মামলাতেও তো শাস্তিদানের হার ২৫ শতাংশের উপর উঠছে না, সে জন্য মামলাগুলিকে মিথ্যে বলা চলে কি? এ ছাড়া বহু অভিযোগকারিণী পরে আবার স্বামীর সঙ্গে থাকতে চান বলে আদালতে ‘ভুল বলেছি’ বয়ান দিয়ে মামলা তুলে নেন, সেই পরিসংখ্যান কিন্তু এনসিআরবি-র সারণিতে নেই।

নারী সংগঠনের অভিজ্ঞতা বলছে যে, বিপন্ন মেয়েরা ৪৯৮এ-তে মামলা দায়ের করতে চান না। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোক গ্রেফতার হলে সেই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথ খোলা থাকবে না, তাঁরা জানেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বেশির ভাগ অভিযোগকারিণী বিয়েটাকে টেকাতে চান যে কোনও মূল্যে, এমনকী তীব্র অপমান আর শারীরিক অত্যাচার সহ্য করেও। ১৯৯৮ সালে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস প্রথম সমীক্ষা চালিয়ে বলে যে, তাদের কাছে কাউন্সেলিং-এর জন্য আসা গৃহবধূদের ১ শতাংশের কম এই ধারায় মামলা দায়ের করতে চেয়েছেন। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাও তা-ই। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৩ বলছে, ৪০ শতাংশ গৃহবধূ পারিবারিক হিংসার শিকার হলেও, মাত্র ০.০৩ শতাংশ অর্থাত্‌ ১০ হাজার জনের মধ্যে মাত্র তিন জন পুলিশে অভিযোগ করেন। বরং, পুলিশ যদি অভিযোগ শুনে বলে যে, অত্যাচারী স্বামীকে এনে উত্তম-মধ্যম দেবে, তা হলে অত্যাচারিতা স্ত্রীরাই হাতেপায়ে ধরে বলেছেন, মারধর না করে যেন একটু বুঝিয়ে বলা হয়। সেই মেয়েরা জানেন যে, শ্বশুরবাড়ির আশ্রয় হারালে তাঁর আর মাথা গোঁজার কোনও ঠাঁই নেই। ছেলেমেয়ে থাকলে তো আরওই চিন্তা।

বরং নারী সংগঠন বা সহৃদয় বহু মানুষের অভিজ্ঞতা হল, প্রকৃত নির্যাতনের ঘটনায় থানায় ৪৯৮এ দায়ের করানো কী কঠিন। এই বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী ফ্লেভিয়া অ্যাগনেস বলছেন, নিম্ন আদালতের উকিলদের একাংশ ও পুলিশ এর অপব্যবহারের জন্য দায়ী। বহু ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মনে করেন, মেয়েদের একটু-আধটু মারধর খাওয়াই উচিত। নানা স্তরের বিচারকদের মধ্যে সমীক্ষা দেখেছে যে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা নিজের পরিবারের মেয়েদের মানিয়ে নিতে বলবেন। আবার, সুপ্রিম কোর্টের এক মহিলা বিচারক নিজের অবিবাহিতা কন্যাকে আয়করের খাতায় ‘দায়’ হিসেবে দেখিয়েছেন। বিচারকদের ব্যক্তিগত ধারণা বা বিশ্বাস বিচারক হিসেবে সিদ্ধান্তের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?

অধিকাংশ নিগৃহীতা প্রাথমিক ভাবে, শাস্তি নয়, নিজের বা নিজেদের জন্য সুরক্ষা চান। সেটা কিন্তু ৪৯৮-এ দিতে পারে না। সত্যিকারের নির্যাতনের ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তরা এই ধারায় গ্রেফতার হল কি না, তাতে নির্যাতিতাদের কিছু কি যায় আসে? তাঁরা যদি সত্যিই শারীরিক আঘাত পেয়ে থাকেন, আর সত্যিই যদি পুলিশ এফ আই আর নেয়, তা হলে তো সেটি অন্য জামিন-অযোগ্য ধারাতেও পড়ছে, ফলে সেই ধারা মোতাবেক গ্রেফতার তো সুপ্রিম কোর্টের এই নতুন রায় আটকাতে পারে না।

এ রায় অন্য কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। রায় বলছে, মামলায় অভিযোগ দায়ের হলে গ্রেফতারের যুক্তি দিতে হবে পুলিশকে। সে ক্ষেত্রে নতুন ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধনে গ্রেফতারি নিয়ে যে নির্দেশিকা ছিল, তা কার্যকর করা হবে কি? গ্রেফতার যুক্তিসঙ্গত হয়েছে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখার দায় যেমন পুলিশের তেমনই ম্যাজিস্ট্রেটেরও। না হলে দুজনকেই বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে এবং তা আদালত অবমাননা পর্যন্ত যেতে পারে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের এক সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছে, আদালতগ্রাহ্য অপরাধে এফ আই আর বাধ্যতামূলক, না হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশকে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে। অথচ পুলিশ এফ আই আর নেয়নি বলে আদৌ কোনও আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে বলে এ পর্যন্ত খবর মেলেনি।

৪৯৮এ ধারাটির পরিপ্রেক্ষিতটা মনে রাখা দরকার। ১৯৮৩ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে পণের ক্রমবর্ধমান দাবি ও পণজনিত মৃত্যুর ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই ধারাটি যোগ করা হয়েছিল। ধারাটির তিনটি বৈশিষ্ট্য:
১) শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতনও এ বার শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে,
২) এটি জামিন-অযোগ্য, মানে থানা থেকে নয়, অভিযুক্তকে হাজির করার পর আদালত থেকে জামিন পাওয়া যাবে,
৩) এটি ‘নন-কম্পাউন্ডেবল’, অর্থাত্‌ এক বার অভিযোগ দায়ের করলে তা ফেরত নেওয়া যাবে না,
৪) এটি ‘কগনিজেবল’, অর্থাত্‌ আদালতের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ তদন্ত প্রভৃতিতে এগোতে পারবে।

এই রায়ে না বলা হলেও, এই ধারার আরও দু’টি বৈশিষ্ট্য নিয়েও বিতর্ক আছে। প্রথমত, এই ধারা জামিনযোগ্য হবে কি না, অর্থাত্‌ থানা থেকে জামিন পাওয়া যাবে কি না; আর দ্বিতীয়ত, কম্পাউন্ডেবল, অর্থাত্‌ মিটমাট হয়ে গেলে আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে বা ব্যতিরেকে মামলা তুলে নেওয়া যাবে কি না। ল’ কমিশনের একাধিক রিপোর্ট (সাম্প্রতিকতম ২৪৩, অগস্ট ২০১২), বিচারপতি মলিমথ কমিটির ক্রিমিনাল জাস্টিস রিফর্ম নিয়ে রিপোর্টে (২০০৩) এ নিয়ে নানা মতামত প্রকাশ করেছে, যেখানে দু’দিকের যুক্তিই আছে। বলা হয়েছে, যে সব আত্মীয় এক ছাদের তলায় থাকেন না, তাঁদের থানা থেকে জামিন হোক। কিন্তু না থাকলেই যে তিনি অত্যাচারে উসকানি দেন না বা মানসিক যন্ত্রণা দেন না, তা কি নিশ্চিত ভাবে বলা যায়?

জামিনের থেকেও বেশি সমস্যা মামলাটি ‘কম্পাউন্ডেবল’ বা প্রত্যাহারসম্ভব থাকবে কি না, তা নিয়ে। অনেকের মতে, আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে অশান্তি কম হবে, দুজনেই পুনর্বিবেচনার সময় পাবেন। কিন্তু এখন সেই সুযোগ না থাকা (কর্নাটকের মতো কিছু রাজ্যে এটি প্রত্যাহারসম্ভব) সত্ত্বেও অভিযুক্ত স্বামী আদালতে গিয়ে প্রেমের বন্যা বইয়ে দিয়ে, মেয়েটিকে দিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার পর স্বমূর্তি ধরেন। তাই প্রত্যাহারসম্ভব হলে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য কত চাপ কাজ করবে, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

সমস্যাটা বড় ও জটিল, তাই সরকারকে বিভিন্ন আইনকানুন, নজরদারি সংস্থা, নির্দেশিকা, অনেক কিছু করতে হবে। ভাবতে হবে, নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রক নারী কমিশনকে সামনে রেখে, নারী সংগঠনগুলিকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে পারে কি না। কিংবা, নারীনিগ্রহের ক্ষেত্রে থানায় কখন ৪৯৮এ আর কখন পারিবারিক হিংসা আইনে অভিযোগ দায়ের করা যাবে, কোন ক্ষেত্রে কী ভাবে এগোনো যাবে। সুস্পষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করা জরুরি। টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস’কে সামনে রেখে, নারী সংগঠনদের সঙ্গে নিয়ে মহারাষ্ট্রের পুলিশ কাজ করেছে, কাজ এগিয়েছে অন্ধ্রে বা তামিলনাড়ুতেও। কর্মক্ষেত্রে নারীর হেনস্থা রুখতে যেমন কমিটি গড়তে হয়, তেমনই গার্হস্থ্য হিংসা রোধে কেন সারা রাজ্যে কয়েক হাজার নজরদারি কমিটি থাকবে না? পাড়ায় পাড়ায় নাগরিক কমিটির মতো পাড়ায় নারী সুরক্ষা কমিটি তৈরি হোক। তবে দেখতে হবে যাতে এ সব কমিটি নীতি-পুলিশগিরির ফাঁদে না পড়ে। দেখতে হবে যাতে কোনও অভিযোগ এলে কমিটিগুলি পুলিশকে সাহায্য করতে পারে। কেবল আইন ও বিচার নয়, সমাজের নিজের নজরদারি দিয়েও লড়াইটা চালানো দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial saswati ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE