পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের দাপট একদা ‘সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সত্য’ ছিল। দলতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করিলে দল কী করিতে পারে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হইয়া সন্তোষ ভট্টাচার্য বুঝিয়াছিলেন। পরে আর কাহারও সেই দুর্ভাগ্য হয় নাই, কারণ তত দিনে দলীয় আনুগত্যই উচ্চ (অথবা অনুচ্চ, যে কোনও) পদে আসীন হইবার প্রধানতম শর্ত রূপে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছিল। ২০১১ সালে যখন পরিবর্তনের ধ্বজা উড়াইয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গবিজয় করিলেন, তখন আরও বহু ক্ষেত্রের ন্যায় শিক্ষাক্ষেত্রটিকেও দলতন্ত্রের বাহিরে আনিবার প্রত্যাশা তাঁহার নিকট ছিল। দলতন্ত্রের মহিমা সম্যক উপলব্ধি করিতে তখনও সম্ভবত তাঁহাদের কিছু বাকি ছিল। ফলে, তাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াটিকে ‘রাজনীতি-মুক্ত’ করিবার শপথ লইয়া বসিলেন। বামফ্রন্ট আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটই আচার্যের নিকট উপাচার্য পদে তিনটি নাম প্রস্তাব করিত। পরিবর্তনের হাওয়ায় সেই নিয়ম উড়াইয়া দিয়া শাসকরা ঠিক করিলেন, অতঃপর সার্চ কমিটি গড়িয়া উপাচার্য সন্ধান হইবে। তিন জনের সার্চ কমিটি গঠিত হইবে আচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত তিন শিক্ষাবিদকে লইয়া। তাঁহারা উপাচার্য পদের যোগ্য প্রার্থী খুঁজিয়া আচার্যকে জানাইবেন। সরকার, এবং দল, প্রক্রিয়াটির সহিত দূরত্ব বজায় রাখিবে।
অনভিজ্ঞতাপ্রসূত এহেন সদিচ্ছা অবশ্য বেশি দিন টেকে নাই। শাসকরা স্থির করিলেন, সার্চ কমিটিতে ইউজিসি-র প্রতিনিধি প্রয়োজন নাই রাজ্য সরকার এক জনকে মনোনীত করিবে। খাতাকলমের হিসাব বলিবে, সরকার এক জন প্রতিনিধি বাছিলেও তিনি কমিটিতে সংখ্যালঘু, কারণ অন্য দুই প্রতিনিধি যথাক্রমে রাজ্যপাল ও বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা মনোনীত। বাস্তবজ্ঞান অবশ্য বলিবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক হইতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, সব গোত্রের আনুগত্যই কালীঘাটের প্রতি। ফলে, সার্চ কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় মনোনীত সদস্যও প্রকারান্তরে কালীঘাটেরই প্রতিনিধি। অতএব, ইউজিসি-র বদলে সরকারি প্রতিনিধি আনিবার সিদ্ধান্তটিতেই পুনঃঅনিলায়নের ব্যবস্থা পাকা হইয়া গিয়াছিল। দৃশ্যতই, তাহাতে সরকারের মন উঠে নাই। শিক্ষামন্ত্রী জানাইলেন, অতঃপর সরকারের সহিত পরামর্শ করিয়া আচার্য নিজের প্রতিনিধি বাছিবেন। তিনে তিন লখিন্দরের লৌহবাসরে সাপ দূরস্থান, সুচ গলিবার ছিদ্রটুকুও থাকিল না। বাম আমলে তবু নিরপেক্ষতার মুখোশটি বজায় রাখিবার সামান্য তাগিদ চোখে পড়িত। পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা সেই বালাইও আর রাখিলেন না। বলিয়াই দিলেন, তাঁহারা নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহেন।
রাজ্যপালকে নিজের পছন্দের প্রার্থী বাছিতে দিলেও যখন নিয়ন্ত্রণ করিতে সমস্যা ছিল না, তখন এই সিদ্ধান্ত কেন? রাজধর্ম হইতে বিচ্যুতির যে অধ্যায়টি চুপিসাড়েই চুকাইয়া ফেলা যাইত, তাহার এমন বিজ্ঞাপন কিঞ্চিত্ কাঁচা কাজ হইয়াছে বলিয়া কেহ বোধ করিতেই পারেন। অপর একটি সম্ভাবনাও উড়াইয়া দেওয়া যায় না, বিশেষত রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম দেখিলে। রাজ্য সরকার একটি বার্তা প্রেরণ করিতেছে। শত অভিযোগ উঠিলেও মনিরুল ইসলাম বা অনুব্রত মণ্ডলরা মুখ্যমন্ত্রীর সহিত একই মঞ্চে অবিচল থাকিতে পারেন। অম্বিকেশ মহাপাত্র বা শিলাদিত্য চৌধুরীর ঘটনায় বহু ধিক্কারের পরও সুমন মুখোপাধ্যায়কে একই ভঙ্গিতে পুলিশ হয়রান করিতে পারে। তাপস পাল মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষপুটে আশ্রয় পাইতে পারেন। বার্তাটি পরিষ্কার শাসক দলের যেমন ইচ্ছা, রাজ্য তেমনই চলিবে। কোনও আপত্তি, কোনও সমালোচনাই গ্রাহ্য হইবে না। শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্রও খিড়কির দরজা দিয়া নহে, বুক চিতাইয়া প্রতিষ্ঠিত হইবে। ইহাকে অনিলায়ন বলিলে প্রয়াত অনিল বিশ্বাসের প্রতি অবিচার হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy