Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

অবিজ্ঞান কংগ্রেস

বৈদিক ভারতে এরোপ্লেন চলত, এমন ‘পেপার’ বিজ্ঞান কংগ্রেসে পড়তে দেওয়া হবে কেন? হবে, কারণ ওটা আসলে এক হট্টমেলা। বরাবরই।ভাগ্যিস ‘বেদিক এরোপ্লেন’ ব্যাপারটা সংবাদের শিরোনামে এল। নয়তো ভারতে বিজ্ঞানের বাৎসরিক ‘কুম্ভমেলা’ লোকচক্ষুর অগোচরে কেটে যেত। যেমন কাটে ফি-বছর। বছরের প্রথম সপ্তাহে প্রথা মেনে দেশের প্রধানমন্ত্রী মেলা উদ্বোধন করবেন। দেবেন ভাষণ। যেহেতু উদ্বোধক খোদ প্রধানমন্ত্রী, তাই অনুষ্ঠান ঘিরে আয়োজকরা শশব্যস্ত। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে এলে মিডিয়া কি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? অতএব, মেলা পাবলিসিটিও পায়।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

ভাগ্যিস ‘বেদিক এরোপ্লেন’ ব্যাপারটা সংবাদের শিরোনামে এল। নয়তো ভারতে বিজ্ঞানের বাৎসরিক ‘কুম্ভমেলা’ লোকচক্ষুর অগোচরে কেটে যেত। যেমন কাটে ফি-বছর। বছরের প্রথম সপ্তাহে প্রথা মেনে দেশের প্রধানমন্ত্রী মেলা উদ্বোধন করবেন। দেবেন ভাষণ। যেহেতু উদ্বোধক খোদ প্রধানমন্ত্রী, তাই অনুষ্ঠান ঘিরে আয়োজকরা শশব্যস্ত। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে এলে মিডিয়া কি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? অতএব, মেলা পাবলিসিটিও পায়। তবে ওই প্রধানমন্ত্রীর হাতে উদ্বোধনের রিপোর্ট পর্যন্তই। তার পর মেলা চলে আরও চার-পাঁচ দিন। তখন মেলার অন্য চেহারা। মিডিয়া ভোঁ-ভাঁ (নয়তো উৎসবে যোগদানকারীদের থাকা-খাওয়ার দিগদারি নিয়ে রিপোর্ট)। আর ‘ডেলিগেট’ বা ‘মেম্বার’ তকমাধারীরা সোজা ‘সাইট সিইং’-এ মনোযোগী। সিঙ্গল-ফেয়ার-ডাবল-জার্নির সরকারি ব্যবস্থা যাঁদের জন্য, তাঁরা মেলায় এসে শহর ভ্রমণে মন দেবেন না, তা কি হয়?

হ্যাঁ, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন, যাতে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ (দু’বছর আগে কলকাতা অধিবেশনে অভ্যাগতের সংখ্যা ছিল ১২,০০০), তার কপালে ওই ‘মেলা’ তকমা বহুকালের। কর্তাব্যক্তিরা এই অভিধাকে নিন্দুকের ছিদ্রান্বেষণ মনে করেন, কিন্তু সত্যটা ওই তকমাটিই সমর্থন করে।

সম্প্রতি মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের আতিথেয়তায় আয়োজিত বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১০২তম অধিবেশনে ‘বৈদিক বিমান’ কিসসায় সত্যের সমর্থন মিলল। সেখানে ‘সংস্কৃত ভাষার সূত্রে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার খোঁজ’ শিরোনামাঙ্কিত এক আলোচনাচক্রে যে সব পেপার পড়া হল, তাদের বিষয়বস্তু ‘প্রাচীন ভারতে উদ্ভিদ চর্চার প্রযুক্তিগত প্রয়োগ’, ‘যোগাসনের মূলে স্নায়ুবিজ্ঞান’, ‘প্রাচীন ভারতে শল্যচিকিৎসার অগ্রগতি’ ইত্যাদি। ও সবের পাশাপাশি ছিল আরও এক পেপার: ‘প্রাচীন ভারতে বিমান প্রযুক্তি’। বক্তব্য স্পষ্ট। প্রাচীন ভারতে আকাশপথে ভ্রমণ-প্রযুক্তি গল্পগাছা নয়, বরং তার সমর্থনে প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি সমেত ঐতিহাসিক তথ্য আছে। সংস্কৃত রচনায় উড়ন্ত যান বা বিমান বিষয়ে প্রচুর উল্লেখ আছে, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিজ্ঞানী-ঋষি অগস্ত্য এবং ভরদ্বাজ বিমান নির্মাণ-কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। ভরদ্বাজ-রচিত বৈমানিকশাস্ত্র বিমানবিদ্যার আধার। বিমানের নকশা থেকে চালানোর কৌশল, সবই আলোচনা করা হয়েছে ওখানে। শুধু অন্তরীক্ষে নয়, স্থলে এমনকী জলে, সাবমেরিনের মতো ওই যান চালানোর কথাও বলেছেন ভরদ্বাজ মুনি। একুশ শতকে ভারতীয়দের উচিত প্রাচীন মুনি-ঋষিদের সাফল্য অনুধাবন ও প্রচার।

পুষ্পক রথের কথা শোনা ছিল। নেহাত গল্পের উপাদান হিসেবে সে-সব মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু, একেবারে এরোপ্লেন! ব্যাপারটা কী? ব্যাপার এই যে, বৈমানিকশাস্ত্র এবং ভরদ্বাজ মুনির যোগাযোগের ব্যাপারটা বানানো গল্প। যে সব সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে বেদ-এর রচনাকালে ভারতের আকাশে বিমান উড়ত বলে দাবি করা হয়েছে, সে সব ওই যুগে লেখা নয়। বৈমানিকশাস্ত্র নামে যে গ্রন্থের কথা বলা হয়েছে, তার রচনাকাল ১৯০০ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ। রচয়িতা? পণ্ডিত সুব্বারাও শাস্ত্রী নামে এক ধর্মগুরু। যিনি মারা যান ১৯৪৪ সালে। ধ্যানস্থ অবস্থায় শাস্ত্রীজি যে-সব সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতেন, তা লিপিবদ্ধ করতেন তাঁর শিষ্যরা। পরে তা সংকলিত হয় বৈমানিকশাস্ত্র নামে। ১৯৫১’য় সে বই হাতে পান মহীশূরে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব স্যান্স্কৃট রিসার্চ-এর প্রতিষ্ঠাতা এ এম জয়সার। তাঁর উদ্যোগে প্রচার পায় বৈমানিকশাস্ত্র। সুতরাং, তার প্রাচীনত্বের দাবি মিথ্যা।

কেমন করে জানা গেল এ সব? আসলে বৈমানিকশাস্ত্রের সূত্র ধরে প্রাচীন ভারতে বিমান চলাচলের দাবি হালফিলের নয়, চল্লিশ বছর আগেও উঠেছিল। বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস-এর এয়ারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচ বিজ্ঞানী সে দাবি পরীক্ষাও করেছিলেন। খোঁজ নিয়ে তাঁরা জেনেছিলেন, বৈমানিকশাস্ত্র মোটেই প্রাচীন রচনা নয়। আর তার সারবত্তা? সে ব্যাপারে তাঁদের তদন্তের ফল আরও চমকপ্রদ। বিমান তৈরির জন্য বাতাসের চেয়ে ভারী বস্তু ভাসমান হলেই চলে না, গতিশীলও হতে হয়। পাঁচ গবেষক বৈমানিকশাস্ত্রে বর্ণিত বিমানের নকশা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারেন, ও রকম যান শূন্যে ভাসমান এবং চলমান হতে পারে না। বিজ্ঞানের নিয়মকানুন তো আর প্রাচীন যুগে আজকের চেয়ে আলাদা ছিল না যে, ও রকম বিমান আকাশে উড়বে।

ঠিক এখানেই বিজ্ঞান কংগ্রেসের টিকি ধরে টান দিতে হয়। বেদের যুগে বিমান চলাচল হত, এমন দাবি করে পেপার লেখা হতে পারে। ভুয়া হলেও, প্রাচীন ভারতীয়দের কৃতিত্বের ধ্বজা তুলে ধরতে কেউ আগ্রহী হতে পারেন। কিন্তু, কোন পেপার কংগ্রেসের অধিবেশনে পড়া হবে, সে ব্যাপারে একটা নিয়ন্ত্রণ তো থাকবে। এ ক্ষেত্রে ওই নিয়ন্ত্রণ আদৌ ছিল না। কেন তা ছিল না, সে প্রশ্নের জবাব কি বিজ্ঞান কংগ্রেসের কর্তাব্যক্তিরা দেবেন? না কি তাঁরা এ রকম পেপার অধিবেশনে পড়ার অনুমতি দিয়ে কেন্দ্রের নবাগত সরকারকে তোষামোদ করতে চেয়েছিলেন?

চমৎকার মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক এইচ এস মুকুন্দ। সেই গবেষক, যিনি চল্লিশ বছর আগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতে বিমান চলাচলের সত্যতা পরীক্ষার কাজে। এত দিন পরে আবার সেই দাবির সমর্থনে বিজ্ঞান কংগ্রেসে পেপার পড়ার খবর শুনে তিনি বলেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে যিনি পেপার লিখেছেন, তাঁর চেয়ে ঢের বেশি দোষী অধিবেশনের সংগঠকরা, যাঁরা ও রকম একটা পেপার পড়ার অনুমতি দিয়েছেন। ওঁরা বিজ্ঞানের পায়ে কুড়ুল মেরেছেন।’

বিজ্ঞান কংগ্রেসের কর্তাব্যক্তিরা বোধহয় ভুলে গিয়েছেন যে, ১৯১৪ সালে কংগ্রেস গঠনের সময় বলা হয়েছিল, সংগঠনের পয়লা নম্বর লক্ষ্য হবে ‘বিজ্ঞানের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া’। আহা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কী নমুনা! পশ্চিমে ধর্মপ্রাণ মানুষের অভাব নেই। তাঁরা অনেকেই চার্লস ডারউইন-প্রবর্তিত বিবর্তনবাদের সমালোচক: তাঁরা মানতে চান না, মানুষ পশুর বিবর্তিত রূপ। কিন্তু ভাবুন তো, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স কিংবা ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর অধিবেশনে বিবর্তন-বিরোধী পেপার পড়া হচ্ছে!

আসল সমস্যা মূলেই। ভারতে বিজ্ঞান কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন যে মেলা বই অন্য কিছু নয়, তার বড় কারণ কংগ্রেসের গঠন। কারা এর সদস্য? এর সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং ভারতে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে উৎসাহী যে কেউ এই সংগঠনের সদস্য হওয়ার যোগ্য’। এ রকম যে সংস্থা, তার বার্ষিক অধিবেশনের মেলায় পরিণত হতে বাধা কোথায়? এক বার ভাবুন তো, বিজ্ঞান কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হচ্ছে, আর সেখানে তাঁর গবেষণার নতুন ফল জানাচ্ছেন বিজ্ঞানী অশোক সেন। স্বপ্নেও সত্যি হবে না এমন ঘটনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pathik guha editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE