পোপ ফ্রান্সিস ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের সদর দফতর ভ্যাটিকানে এমন ২০টি দম্পতির বিবাহ অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করিয়াছেন, যাঁহারা দীর্ঘ কাল সহবাস করিতেছেন এবং যাঁহাদের অনেকেরই সন্তানও রহিয়াছে। ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ইহা অভিনব। এই ধর্ম, অন্য নানা ধর্মের মতোই, নরনারীর বিবাহপূর্ব মিলনকে অধর্মাচরণ বলিয়া গণ্য করিয়া আসিয়াছে। বস্তুত, এই ধরনের মিলন, সহবাস বা সন্তানধারণকে অপবিত্র ও অন্যায় বলিয়াই গণ্য করা হইয়া থাকে। তাহাতে যে এই ধরনের আচরণ সমাজ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে, এমন নয়। বরং নিষেধাজ্ঞা, পাপের ভয়, অনন্ত নরকবাসের আশঙ্কা সত্ত্বেও সামাজিক মানুষ বারংবার লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘন করিয়াছে। ইউরোপ-আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকায় এই উল্লঙ্ঘন এতই ব্যাপক যে, ইহাকে পাপাচার রূপে শনাক্ত করিতে গেলে ক্যাথলিক চার্চ নিজেই অপ্রাসঙ্গিক এবং সমাজবিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িতে পারে। পোপ ফ্রান্সিস তাই সামাজিক বাস্তবতাকে শিরোধার্য করাই শ্রেয় মনে করিয়াছেন।
পূর্বসূরির তুলনায় বর্তমান পোপ নানা প্রশ্নে অনেক বেশি বাস্তববাদী আচরণ করিয়া আসিতেছেন। কেবল বিবাহপূর্ব যৌনতা নয়, গর্ভপাত, গর্ভনিরোধকের ব্যবহার, এমনকী সমকামিতার মতো বিষয়েও ক্যাথলিক চার্চকে পুরানো অবস্থান পরিহারের আর্জি জানাইয়াছেন। সমকামিতা যেমন বরাবরই সকল ধর্মে পাপাচার বলিয়া গণ্য। অথচ সভ্যতার আদি কাল হইতেই সমাজে ইহা বহুলপ্রচলিত। ধর্মগুরুদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করিয়া যৌনতা আপন প্রকাশের নানাবিধ পথ খুঁজিয়া লইয়াছে। এগুলি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধ্বজাধারীরা সর্বত্রই নিষিদ্ধ করিয়াছেন। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের মত: ‘আমি বিচার করার কে? যদি কেহ ঈশ্বরকে অন্বেষণ করে এবং শুভেচ্ছায় প্রাণিত হয়, তবে তাহার আচরণের বৈধতা লইয়া আমি মত দিবার কে’? ফ্রান্সিস জানেন, ধর্মকে প্রাসঙ্গিক থাকিতে হইলে জীবনধারার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া চলিতে হইবে, দেখিতে হইবে, ধর্ম যেন নিগড় হইয়া না দাঁড়ায়, ব্যক্তির স্ফূর্তি, বিকাশ ও স্বাধীনতার পথে অবরোধ সৃষ্টি না করে। এই বাস্তববোধ সমাজের পক্ষে শুভ, ধর্মপ্রতিষ্ঠানের পক্ষেও।
কথাটি অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও সত্য। বিভিন্ন দেশে রকমারি ইসলামি গোষ্ঠী ইসলামের যে ভাষ্য খাড়া করিতেছে, মুসলিম জনসমাজের উপর চাপাইয়া দিতেছে, তাহা একবিংশ শতকের মানবজীবনের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আবার, হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী বিবিধ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এ দেশের সমাজে আপন গোঁড়ামির বলয় প্রসারিত করিতে অধুনা বিশেষ তৎপর। ইহাও লক্ষণীয় যে, বিশেষত নারীর স্বাধীনতা খর্ব করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের নামে সংকীর্ণ গোঁড়ামি অনেক সময়েই আচণে অভিন্ন। সেই গোঁড়ামির প্রবক্তারা মহিলাদের পর্দানশিন রাখিতে ব্যগ্র, তাঁহাদের স্বাধীন বিচরণের ঘোর বিরোধী, তাঁহাদের ‘সতীত্ব’ রক্ষায় যৎপরোনাস্তি উদ্গ্রীব। তাঁহাদের জন্য নিত্যনূতন পোশাক-বিধি তৈয়ার হইতেছে, বাড়ির বাহিরে যাতায়াত, মোবাইল ফোনের ব্যবহার, পুরুষ সহকর্মীদের সহিত সমভাবে প্রতিযোগিতার স্বাধীনতা নানা অজুহাতে খর্ব করা হইতেছে। এই ধর্মধ্বজীদের জানিয়া এবং মানিয়া লওয়া দরকার, ধর্মগুরুর প্রজ্ঞায় (ও অজ্ঞতায়) ধর্ম সীমিত থাকিতে পারে না, সামাজিক দৈনন্দিনতায় তাহাকে প্রাসঙ্গিক হইয়া উঠিতে হয়। পোপ ফ্রান্সিসকে অভিনন্দন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy