Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

অভিমুখ

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তী মহাশয়ের আচরণ দেখিলে বাঘা বাইন অবশ্যই বলিতেন, ‘কী দাপট’! তাঁহার পদটির ভার সম্পর্কে তাঁহার টনটনে জ্ঞান। তিনি কী করিবেন, কেন করিবেন, সেই বিষয়ে কেহ কোনও প্রশ্ন করিলেই তিনি সেই জিজ্ঞাসাকে সপাটে উড়াইয়া দিয়া বলিতেছেন, ‘বলিব না’।

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তী মহাশয়ের আচরণ দেখিলে বাঘা বাইন অবশ্যই বলিতেন, ‘কী দাপট’! তাঁহার পদটির ভার সম্পর্কে তাঁহার টনটনে জ্ঞান। তিনি কী করিবেন, কেন করিবেন, সেই বিষয়ে কেহ কোনও প্রশ্ন করিলেই তিনি সেই জিজ্ঞাসাকে সপাটে উড়াইয়া দিয়া বলিতেছেন, ‘বলিব না’। বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা বিষয়ে কী ব্যবস্থা গৃহীত হইতেছে, তাহা জানাইতে বা বোঝাইতে তিনি বাধ্য নহেন। ছুটি ফুরাইয়া যাওয়া সত্ত্বেও কেন অদ্যাবধি তিনি নিজের অফিসে যান নাই, রীতিবহির্ভূত ভাবে— অশোভন ভাবেও— অন্যত্র বসিয়া অফিসের কাজ সারিয়াছেন, তাহাও তিনি বলিতে রাজি নহেন। ভদ্রলোকের এক কথা: ‘তাঁহার ব্যাপার’ তিনি সামলাইবেন। প্রশ্ন হইল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম, অবস্থা-ব্যবস্থা সবই কি উপাচার্যের ‘নিজস্ব’ ব্যাপার? যাহা লইয়া আলোচনা ও বিনিময়ের জায়গা নাই বলিলেই চলে? প্রশ্নটিকে আরও বৃহত্‌ করিয়া দেখা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে চলিবে, কী পদ্ধতি অনুসরণ করিবে, কী নীতি গৃহীত হইবে, তাহা কি কেবল কর্তৃপক্ষ নামধারী মুষ্টিমেয় শক্তিশালী ব্যক্তিই স্থির করিবেন? শিক্ষকসমাজ, তাঁহাদের প্রতিনিধি-বর্গ, কিংবা ছাত্রসমাজ এবং তাহাদের প্রতিনিধি গোষ্ঠীর কোনও অর্থময় ভূমিকা থাকা কি বিবেচনাযোগ্য নয়? আধুনিক সমাজ-বোধ কী বলে? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনের অন্তত কিয়দংশেও কি গণতান্ত্রিকতার প্রতিফলন ঘটা উচিত নয়? পরিচালন-পদ্ধতিতে ত্রুটি বা বিকৃতি দেখা দিলে, ছাত্র/শিক্ষকদের কোনও মতামত কি প্রণিধানের যোগ্য নহে?

প্রশ্নটি উঠিতেছে কেননা গত কিছু পশ্চিমি ছাত্র-আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে যে, আধুনিক ‘নব্য’ ছাত্র-আন্দোলনের একটি বিশেষ প্রবণতা, বড় সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের সহিত ‘ক্যাম্পাস’-সংকটকেও জুড়িয়া লইবার প্রয়াস, ও তাহার মাধ্যমে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় নিজেদের অধিকতর অংশগ্রহণের প্রত্যাশা ও দাবি। এমনকী ২০১২ সালের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ নামক মার্কিন দেশের যে ছাত্র-যুব আন্দোলন দুনিয়াকে চমকাইয়া দিয়াছিল, তাহার মধ্যেও স্পষ্ট ছিল, কলেজে কলেজে ক্যাম্পাস-সংক্রান্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভকে আন্দোলনের অঙ্গীভূত করিবার চেষ্টা। ইহা কেবল সমর্থন বাড়াইবার কৌশল ভাবিলে ভুল হইবে। বরং রাজনীতিকে নূতন ভাবে সংজ্ঞা দিবার ও অন্য ভাবে চালনা করিবার এক প্রয়াস ইহার মধ্যে দেখা সম্ভব। বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে যে ছাত্রবিক্ষোভের ধিকিধিকি রেশ এখনও দৃশ্যমান, তাহার মধ্যে একটি বার্তা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। সেই বার্তা হইল: হাতে-গোনা কিছু ব্যক্তির হাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অধিকার কুক্ষিভূত নাই। সম্প্রতি উপাচার্যের প্রেরিত নির্দেশিকার বিরুদ্ধে শিক্ষক-প্রতিনিধির জুটা-র প্রতিবাদও একই প্রশ্ন তুলিয়া দেয়। শিক্ষকদের করণীয়-অকরণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাঁহাদের প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা যে কেবল বাঞ্ছিত নয়, অবশ্যকর্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়কে আজ এই সরল কথাটিও মনে করাইয়া দিতে হইতেছে।

অর্থাত্‌, আধুনিক পৃথিবীর বিপরীত দিকেই পশ্চিমবঙ্গ হাঁটিতে মনস্থ করিয়াছে। যাদবপুরের উপাচার্য হাঁটিতেছেন। তাঁহার সমর্থনে সমগ্র রাজ্য প্রশাসন হাঁটিতেছে। আন্দোলন ইতোমধ্যেই নিবু-নিবু, কত দিন আর ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা কাজকর্ম বাদ দিয়া নিজেদের কথা শোনাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিবে। যে যাহার পথে ফিরিতেছে। কেন্দ্রীভূত হইতে গোষ্ঠীভূত, এমনকী ব্যক্তিভূত হইতেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কেবল যাদবপুর কেন, অন্যান্য কলেজেও চালু হইতেছে কড়া প্রশাসনিক নজরদারি, ছাত্রদের উপর, শিক্ষকদের উপরও। উপাচার্যের স্পর্ধা কিংবা প্রশাসনিক গোয়েন্দা-বাহিনী দিয়া শিক্ষায়তন চালাইবার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কিছু অংশে, কিছু অনাধুনিক পশ্চাদ্পর দেশে কিংবা চূড়ান্ত ক্ষমতাতান্ত্রিক দেশে, নিশ্চয়ই বিদ্যমান। এই রাজ্য আপাতত সেই সব দৃষ্টান্ত সামনে রাখিয়াই অগ্রসর হইতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE