পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বাজেট বহু দিন যাবত্ এক প্রহেলিকা। বামফ্রন্ট আমলে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এক কালে বছরের পর বছর ‘ঘাটতিশূন্য বাজেট’ রচনা করিয়া পরম পরিতৃপ্তির হাসি হাসিতেন, পরবর্তী কালে তাঁহার সেই বালাই ঘুচিয়াছিল, কিন্তু রাজ্য অর্থনীতির মনোহর চিত্র আঁকিবার অভ্যাস শেষ অবধি ঘোচে নাই। প্রতি বছর তাঁহার অঙ্কিত সুন্দর চিত্র দেখিয়া রাজ্যবাসী মনে মনে ভাবিতেন, তাঁহারা কি তবে অন্য কোনও প্রদেশে বাস করিতেছেন? বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র চার বছরেই কল্পকাহিনি নির্মাণের ক্ষমতায় তাঁহার পূর্বসূরিকে বহু দূর ছাড়াইয়া গিয়াছেন। তাঁহার বাজেট-চিত্রটি দেখিয়া তাঁহার মুখ্যমন্ত্রী তথা সর্বেশ্বরী সন্তুষ্ট, ইহাই অমিতবাবুর পরম প্রাপ্তি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার অর্থমন্ত্রীকে পাশে বসাইয়া সাংবাদিক সম্মেলন করিয়াছেন এবং অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর নিজে দিয়াছেন, তাহাই স্বাভাবিক, কারণ তাঁহার সর্বজ্ঞতা সুবিদিত। কিন্তু এ বারের বাজেটে যে কঠিন প্রশ্নটি প্রকট হইয়া উঠিয়াছে, তাহার উত্তর এই নায়কনায়িকাদের নিকট প্রত্যাশা করিয়া কোনও লাভ নাই, কারণ সদুত্তরটি তাঁহারা দিবেন না, বরং প্রশ্নকর্তার উপর ক্ষিপ্ত হইবেন।
প্রশ্নটি সংক্ষিপ্ত: পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি যদি এমনই উজ্জ্বল এবং সচল হয়, এ রাজ্যের আয়বৃদ্ধির হার যদি দশ শতাংশই হইয়া থাকে, তবে মিত্রমহাশয়ের রাজস্বের অঙ্কটি এমন করুণ কেন? পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়ের তুলনায় তাহার রাজস্বের অনুপাতটি জাতীয় গড় অপেক্ষা অনেক কম, সে কথা বহুচর্চিত। এই কথাটি তুলিলেই অমিতবাবুরা তারস্বরে অসীমবাবুদের উদ্দেশে গাল পাড়িবেন, বলিবেন, বামফ্রন্টের আমলেই রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা পুঞ্জীভূত হইয়াছিল, তিনি বরং আদায়ের গতি বাড়াইতে তত্পর হইয়াছেন। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল নহে। রাজস্ব বাড়াইবার জন্য ‘পণ্য প্রবেশ কর’-এর মতো একটি সম্পূর্ণ উন্নয়ন-বিরোধী কর বসাইয়া অমিতবাবু বড় রকমের অন্যায় করিয়াছেন বটে, কিন্তু বামফ্রন্ট আমলে রাজস্ব আদায়ের প্রতি অবহেলা সত্যই বিপুল আকার ধারণ করিয়াছিল এবং তৃণমূল কংগ্রেস আমলে সেই অবহেলা সত্যই কিছুটা কমিয়াছে। কিন্তু ঠিক সেই কারণেই এ বারের হিসাবটি তাত্পর্যপূর্ণ। অর্থমন্ত্রীর নিজের অঙ্কই বলিতেছে, চলতি বছরে বিক্রয় কর বাবদ যত টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধার্য করিয়াছিলেন তিনি, আদায় তাহা অপেক্ষা কম হইতেছে। এবং তাহার পাশাপাশি কম পড়িতেছে জমি-বাড়ি লেনদেনের উপর নির্ধারিত স্ট্যাম্প ডিউটি আদায়ের অঙ্কও। এই দুইটি রাজ্য রাজস্বের বড় উত্স। অর্থনৈতিক লেনদেন স্তিমিত হইলেও এই খাতে রাজস্ব আদায়ও স্তিমিত হয়। আদায়ের তত্পরতা বাড়াইয়া সেই ঘাটতি বছরের পর বছর পূরণ করা সম্ভব নহে। পশ্চিমবঙ্গে অর্থনীতিতে ভাটার টান, অতএব রাজস্ব আদায়ও শ্লথ। দশ শতাংশ আয়বৃদ্ধির গল্পটি সত্য হইলে রাজস্ব আদায়ে এই গতিভঙ্গ হইত না।
এমন একটি শ্লথগতিসম্পন্ন অর্থনীতিতে জোয়ার আনিতে হইলে সর্বশক্তি দিয়া বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে সেই চেষ্টার ‘চ’-ও নাই, বিড়ালের তালব্য শ-আদি তো দূরস্থান। অর্থমন্ত্রী মাঝেমধ্যেই ‘প্রস্তাবিত’ বিনিয়োগের বিচিত্র সব হিসাব দেখাইয়া থাকেন, সেই সব প্রস্তাব কে যে তাঁহার কানে কানে আসিয়া বলিয়া গিয়াছে তিনিই জানেন। এ বারের বাজেটেও তেমন নানা অঙ্ক দেখাইবার ছল আছে, কিন্তু তাহাতেও বিবর্ণতা পালিশ করা যায় নাই। অথচ দান-খয়রাতির বিনোদনী অর্থনীতি ছাড়িয়া একটি বাস্তবমুখী এবং বিনিয়োগ-বান্ধব নীতি রচনা করিবেন, বণিকসভার ভূতপূর্ব কর্ণধারের সাধ্য কী? তাঁহার পাশে উপবিষ্ট যে সর্বাধিনায়িকা, তিনি আর্থিক নীতি বলিতে একটি বস্তুই বোঝেন: হরির লুট। অতএব চল্লিশ লক্ষ সাইকেল, অতএব কন্যাশ্রী এ বার কন্যাশ্রীতর, অতএব জলসার টিকিটে প্রমোদকর মুক্তি। পশ্চিমবঙ্গে বীভত্স মজা চলিতেছে, চলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy