Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

(অ)কর্তব্য

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, সে কথা স্বীকৃত। কিন্তু কর্ত্রীর ইচ্ছায় অপকর্ম স্বীকার করিতে হইবে, এমন কোনও দায় সরকারি আধিকারিকদের নাই। নির্বাচন কমিশন কলিকাতার পুলিশ কমিশনারের পদ হইতে রাজীব কুমারকে সরাইবার নির্দেশ প্রদানের পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব কমিশনের নিকট যে ‘প্রতিবাদপত্র’ পাঠান, অনুমান করা যায়, তাহা তাঁহার ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রকাশ নহে, মুখ্যমন্ত্রীর অভিলাষই এতদ্দ্বারা ব্যক্ত হইয়াছিল।

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, সে কথা স্বীকৃত। কিন্তু কর্ত্রীর ইচ্ছায় অপকর্ম স্বীকার করিতে হইবে, এমন কোনও দায় সরকারি আধিকারিকদের নাই। নির্বাচন কমিশন কলিকাতার পুলিশ কমিশনারের পদ হইতে রাজীব কুমারকে সরাইবার নির্দেশ প্রদানের পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব কমিশনের নিকট যে ‘প্রতিবাদপত্র’ পাঠান, অনুমান করা যায়, তাহা তাঁহার ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রকাশ নহে, মুখ্যমন্ত্রীর অভিলাষই এতদ্দ্বারা ব্যক্ত হইয়াছিল। নির্বাচন কমিশন যদি সেই চিঠির ভাষা ‘এক জন আমলার পক্ষে অনুপযুক্ত’ মনে করিয়া থাকেন, দোষ দেওয়া চলে না। কারণ, ওই চিঠিতে বলা হইয়াছিল, রাজীব কুমারের বদলির ফলে ‘পুলিশের মনোবল আহত হইবে এবং তাহার পরিণামের জন্য রাজ্য সরকার দায়ী থাকিবে না’। কথাটির মর্মে প্রচ্ছন্ন সতর্কবাণী রহিয়াছে। বিশেষত, রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ আধিকারিক যখন এমন কথা লেখেন, তখন হয়তো তাহাকে আর প্রচ্ছন্ন বলিবার উপায় থাকে না।

নির্বাচনের সময় রাজ্য প্রশাসনের অধিকার খর্বিত বলিয়া বলিয়া দুর্নীতি-অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা লওয়া যায় না, আর নির্বাচন কমিশনের প্রতি (মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসাবে) এমন প্রকট উষ্মা প্রকাশ করা যায়? প্রশ্ন কেবল একটি চিঠি লইয়া নয়। মূল এবং গভীর প্রশ্ন সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনযন্ত্রের চালক আমলাদের সম্পর্ক লইয়া। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সম্পর্ক ‘সমানে সমানে’ নহে। নীতি নির্ধারণের অধিকার নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রিসভার, আধিকারিকদের দায়িত্ব সেই নীতি অনুসারে প্রশাসন চালানো। কিন্তু তাহার অর্থ অন্ধ ভাবে আজ্ঞা পালন করা নহে। প্রথমত, বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতে প্রশাসন চালনার নির্দিষ্ট পদ্ধতি তৈয়ারি হয়, মন্ত্রীরা সেই পদ্ধতি লঙ্ঘনের আদেশ দিলে আপত্তির নানা স্বীকৃত পথ আছে। দ্বিতীয়ত, নীতি ও পদ্ধতির উপরে থাকে নৈতিকতার নিজস্ব দাবি। যে কাজ অনৈতিক, মন্ত্রী, এমনকী সর্বাধিনায়িকা মুখ্যমন্ত্রী করিতে বলিলেও তাহা করা উচিত কি না, সে বিষয়ে আধিকারিকদের যথেষ্ট চিন্তা করা বিধেয়। এমন ধর্মসংকটের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন দেশে বা রাজ্যে বিভিন্ন জমানায় আমলাদের হইয়াছে। কোনও কোনও জমানায় অন্যায় আদেশের বহর অতিরিক্ত প্রবল হয়। তুঘলকি শাসনে আমলাদের সমস্যা বাড়িবে, তাহা অস্বাভাবিক নহে।

সেখানেই তাঁহাদের বাড়তি দায়িত্ব। কঠিন পরিস্থিতিতে নৈতিকতার দাবি এবং উপরওয়ালার অন্যায় আদেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলিবার দায়িত্ব। কেহ কেহ হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, অনাচারের নির্দেশ পাইলে বিনীত ভাবে কিন্তু দৃঢ় ভাবে জানাইয়াছেন, ইহাতে তাঁহার আপত্তি আছে। আর কিছু না হোক, একটি নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করিতে বলিলেও এক ধরনের নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা হয়। নির্বাচনের সময় বহু প্রশাসনিক বিষয়েই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তেমন সিদ্ধান্তের ফলে ‘পুলিশের মনোবল আহত হইবে এবং তাহার পরিণামের জন্য রাজ্য সরকার দায়ী থাকিবে না’ বলিলে কার্যত নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ার লইয়াই প্রশ্ন তোলা হয়, রাজ্য সরকারের সহিত কমিশনের অবাঞ্ছিত এবং বিপজ্জনক সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান জমানায় তেমন সংঘাত অতীতে ঘটিয়াছে, এ বারেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে বারংবার কমিশনের বিরুদ্ধে আপন তীব্র ক্ষোভ স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় ও ভঙ্গিতে প্রকাশ করিয়া চলিয়াছেন। প্রশাসনের আধিকারিকরা এই রাজনৈতিক কুনাট্য হইতে নিজেদের যথাসম্ভব দূরে রাখিবেন, ইহাই কাম্য। কিন্তু যাহা কাম্য এবং যাহা বাস্তব, দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব বিস্তর, হয়তো অসেতুসম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE