Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আইনের অনাচার

নীতি ও আইন যে সমার্থক নহে, ভারতীয় দণ্ডবিধির কিছু কিছু ধারার দিকে তাকাইলে তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। এত দিন পর্যন্ত ৪৯৮এ ছিল তেমনই একটি ধারা। মূলত পণনির্যাতন-বিরোধী এই আইন যে ভাবে অভিযোগ দায়ের-মাত্র অভিযুক্তদের বিনা প্রশ্নে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দিয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণত মৌলিক অধিকার-বিরোধী অর্থাত্‌ ভারতীয় সাংবিধানিক নীতির বিরোধী।

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

নীতি ও আইন যে সমার্থক নহে, ভারতীয় দণ্ডবিধির কিছু কিছু ধারার দিকে তাকাইলে তাহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। এত দিন পর্যন্ত ৪৯৮এ ছিল তেমনই একটি ধারা। মূলত পণনির্যাতন-বিরোধী এই আইন যে ভাবে অভিযোগ দায়ের-মাত্র অভিযুক্তদের বিনা প্রশ্নে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দিয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণত মৌলিক অধিকার-বিরোধী অর্থাত্‌ ভারতীয় সাংবিধানিক নীতির বিরোধী। কোনও অভিযোগ তোলাই তো অভিযোগ প্রমাণ করার একমাত্র শর্ত হইতে পারে না, এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হইলে কারাবাস করিতে বাধ্য করা রীতিমত মৌলিক অধিকারবিরোধী। অথচ ৪৯৮এ এত দিন এই অধিকারই অভিযোগকারী পক্ষ ও পুলিশকে দিয়া আসিয়াছে। বিবাহিত, এমনকী বিবাহবিচ্ছিন্ন, স্ত্রীর পক্ষ হইতে স্বামীগৃহে নির্যাতনের অভিযোগ উঠিলেই স্বামী ও তাহার পরিবারবর্গকে বিচার-ব্যতিরেকে তত্‌ক্ষণাত্‌ গ্রেফতার করিবার ঢালাও বন্দোবস্ত থাকিয়াছে এই আইনে। নীতিগত ভাবে বিচার করিলে, মৌলিক মানবাধিকারের যে যুক্তি পোটা, টাডা কিংবা মিসা-র মতো দমনমূলক আইনগুলির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে তোলা হইয়াছে, সেই একই কারণে এই আইনটিও অত্যন্ত আপত্তিকর। ইহাদের মধ্যে ক্ষেত্রগত বা অভিমুখগত বিভেদ থাকিলেও কোনও নীতিগত বিভেদ নাই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ ও প্রশাসন কখনওই অপরাধ প্রমাণ না করিয়া কোনও নাগরিককে অপরাধী সাব্যস্ত করিতে পারে না। ৪৯৮এ ধারার এই আসুরিক অনৈতিকতার দিকে অনেক দিন ধরিয়াই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হইতেছে। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালত এই অন্যায় ধারার সংশোধনী পেশ করিল।

অতঃপর, অভিযোগ আসিলেই স্বামী ও তাহার পরিবারকে গ্রেফতার করা চলিবে না। গ্রেফতার ম্যাজিস্ট্রেট-এর তদন্তসাপেক্ষ হইতে হইবে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪১ নম্বর ধারায় অপরাধের যে তালিকা দেওয়া আছে, সেই তালিকার সহিত মিলাইয়া দেখিতে হইবে, অভিযোগ বিধিসিদ্ধ কি না। আইন পরিবর্তনের কারণ হিসাবে বিচারপতিরা এই আইনের ব্যাপক অপব্যবহারের কথাই বলিয়াছেন। বাস্তবিক, বহু ক্ষেত্রে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিতে এই আইনের তাত্‌ক্ষণিক গ্রেফতারের আশ্রয় লওয়া হয়। তথ্য বলিতেছে, শেষ পর্যন্ত মোট অভিযুক্তের অত্যল্প অংশই বিচারে দোষী প্রমাণিত হন, নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় জামিন-অযোগ্য গ্রেফতার ও অনির্দিষ্ট কারাবাসের পর অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করা গেল না। উল্লেখ্য, আদালত কিন্তু এই আইনে গ্রেফতার করা আটকাইয়া দেয় নাই, কেবল তাহার তাত্‌ক্ষণিক তথা যান্ত্রিক পদ্ধতিটি পাল্টাইয়াছে। অর্থাত্‌, সাধারণ আইনের মতো এই আইনের অপব্যবহারও সম্পূর্ণত আটকানো হয়তো সম্ভব নয়। আদালত কেবল চাহিয়াছিল, এই বিশেষ আইন যে বিশেষ অপব্যবহারের সুযোগ করিয়া দেয়, তাহা আটকানো।

এমনও নয় যে আইনটির কার্যকারিতা সম্পূর্ণ হারাইয়া গেল। নারী সংগঠনগুলি হয়তো এমনই ভাবিয়া বিক্ষুব্ধ ও হতাশ বোধ করিতেছে, কিন্তু অপব্যবহারের পাশাপাশি বহু ক্ষেত্রে বধূ-নির্যাতনের বিষাক্ত পরিবেশের বিরুদ্ধে এই আইন যে ভাবে মহাস্ত্র হইয়া উঠিয়াছিল, পরিবর্তনের পরও তাহার ধার নষ্ট হইবার কারণ নাই, যদি অভিযোগগুলির যথেষ্ট সারবত্তা থাকে। তবে অপব্যবহার বা সদ্ব্যবহার, কোনওটিই শেষ কথা নয়, কোনও আইন ভাল না মন্দ, তাহার মীমাংসার ভিত্তিটি আসলে নৈতিক। অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রেও যেমন, বধূনির্যাতনবিরোধী আইনের ক্ষেত্রেও একই ভাবে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার উপরই ভরসা রাখিতে হইবে। এই ‘ভরসা’ কিন্তু গণতন্ত্রের অন্যতম মূল ভিত্তি। লক্ষ্য যতই মহত্‌ হউক, বিনা তদন্তে বা বিনা বিচারে গ্রেফতার গণতন্ত্রের সেই নৈতিক ভিত্তিতে কুঠারাঘাত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE