কলিকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিয়া জানাইয়া দিলেন, তিনি, অথবা তাঁহারা, নিরপেক্ষ নহেন। তাঁহারা পক্ষপাতদুষ্ট। শাসকদের প্রতি তাঁহাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। তিনি একটি ভিডিয়ো ফুটেজ দেখাইয়াছেন। যাদবপুরের ছাত্ররা যে পুলিশের সহিত দুর্ব্যবহার করিয়াছিল, সেই ফুটেজে তাহা স্পষ্ট। যাদবপুরে ১৬ তারিখ রাত্রে পুলিশ যে তাণ্ডব করিয়াছে, তাহার জন্য সেই প্ররোচনা যথেষ্ট ছিল কি না, এই প্রশ্নটি বকেয়া থাকুক। কিন্তু, ছাত্রদের অভব্যতার ছবিটি তাঁহার চোখে পড়িল, অথচ পুলিশি তাণ্ডবের যে দৃশ্য গণমাধ্যম-বাহিত হইয়া রাজ্যের, দেশের সব সংবেদনশীল মানুষের মাথা হেঁট করিয়া দিতেছে, সেই ছবি তিনি দেখিতে পাইলেন না? দেখিলেন না, কী ভাবে তাঁহার পুলিশবাহিনী তাঁহারই সন্তানসম ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করিতেছে? না কি, দেখিয়াও তিনি মনে করিয়াছেন, যে ছাত্ররা শাসক দলের আশীর্বাদধন্য অস্থায়ী উপাচার্যের বিরোধিতা করিবার সাহস পায়, তাহাদের জন্য ইহাই যথেষ্ট সংবেদনশীলতা? পুলিশবাহিনী যে তাহাদের খুন বা ধর্ষণ করে নাই, তাহাই যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচায়ক? নগরপালের এত কথা বলিবার প্রয়োজন ছিল না। তিনি মুখ বন্ধ রাখিলে তাঁহার নির্লজ্জ পক্ষপাতটি এমন প্রকাশ্যে আসিয়া পড়িত না। কিন্তু, বঙ্গেশ্বরীর মন্দিরে অর্ঘ্য চড়াইবার কোনও সুযোগই এই বঙ্গে কেহ হাতছাড়া করিতে নারাজ। অনুমান, কলিকাতার পুলিশ কমিশনারও সেই তাগিদেই চালিত হইয়াছেন।
সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ উদাহরণমাত্র। বঙ্গেশ্বরী যাহা শুনিতে চাহেন, তাহার বাহিরে একটি কথাও এই রাজ্যে বলিবার উপায় কাহারও নাই। ফিরহাদ হাকিম বলিয়া ফেলিয়াছিলেন। অতঃপর, তিনি আর কথা না বলাই মনস্থ করিয়াছেন। তবে, তিনি রাজনৈতিক নেতা, দলনেত্রীর বিরাগভাজন হইলে তাঁহার বিপদ হইতে পারে। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা নিজেদের মেরুদণ্ড কোথায় বিসর্জন দিলেন, সে বিষয়ে রাজ্যবাসীর কৌতূহল থাকিতে পারে। তবে, তাঁহাদের পক্ষেও যুক্তি আছে। সত্যনিষ্ঠ হইয়া দলীয় লাইনের বাহিরে মুখ খুলিলে কী হইতে পারে, দময়ন্তী সেন তাহার মোক্ষম উদাহরণ। কাজেই, তাহাই সত্য, যাহা বঙ্গেশ্বরীর মত। যাদবপুর প্রসঙ্গে সরাসরি কোনও বিবৃতি দেওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রীর হয় নাই। তবে, নামোল্লেখ না করিয়া বলিয়াছেন, ‘ছোট ঘটনা’। রাজ্যবাসী তাঁহার এই প্রতিক্রিয়ায় অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন। তবে, কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, শঙ্কুদেব পণ্ডার বাহিনী কলেজে তাণ্ডব চালাইলে মুখ্যমন্ত্রী যখন ‘ছোট ছেলেদের ছোট ভুল’ মর্মে ক্ষমাসুন্দর চক্ষে তাকাইতে পারেন, তখন যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তিনি এমন উদাসীন কেন? তাহারা মুখ্যমন্ত্রীর রাজনীতির অকুণ্ঠ সমর্থক নহে বলিয়াই কি?
বিনা তদন্তে রায় ঘোষণা করিয়া দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ নেত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছেন। অরবিন্দ ভবনের আলো নিভিল কেন, যে বহিরাগতদের কথা তাঁহারা কলকণ্ঠে বলিতেছেন, তাহারা কে, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র থাকিলে তাহা পাওয়া গেল না কেন, এই সব অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর তিনি তদন্ত শেষ হইবার অপেক্ষায় বকেয়া রাখিলেন। ক্যাম্পাসে পুলিশের আচরণ গ্রহণযোগ্য ছিল কি না, পুলিশ লাঠি চালাইয়াছে কি না, এই প্রশ্নগুলির উত্তরের জন্য বুঝি তদন্তের প্রয়োজন নাই? পুলিশের আচরণ সঙ্গত ছিল, কমিশনার মহাশয় জানিলেন কী উপায়ে? অস্থায়ী উপাচার্যের প্রাণের আশঙ্কা ছিল কি না, তাহাই বা কোটালসাহেবকে কে বলিয়া দিল? দুর্জনে বলিবে, রাজনৈতিক প্রভুদের প্রতি আনুগত্য যখন এতই প্রবল, তখন সরাসরি দলে যোগ দেওয়াই বিধেয়। পুলিশের উর্দির যেটুকু সম্মান অবশিষ্ট আছে, তাহাকে আর কালীঘাটের ধুলায় মিশাইয়া দেওয়ার কী প্রয়োজন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy