Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সাক্ষাৎকার

আমাদের সব কাজেই এখন একটা ব্যবসায়িক দৃষ্টির দাপট: অমর্ত্য সেন

কে কোথা থেকে টাকা করতে পারে সেটাই যেন একমাত্র বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য কোনও কমিটমেন্ট যে থাকতে পারে, সেই উপলব্ধি একেবারে কমে গেছে। কমিটমেন্ট নিয়ে আমরা কেবল খুব জমিয়ে বক্তৃতা দিই। বললেন অমর্ত্য সেনকে কোথা থেকে টাকা করতে পারে সেটাই যেন একমাত্র বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য কোনও কমিটমেন্ট যে থাকতে পারে, সেই উপলব্ধি একেবারে কমে গেছে। কমিটমেন্ট নিয়ে আমরা কেবল খুব জমিয়ে বক্তৃতা দিই। বললেন অমর্ত্য সেন

চিকিৎসা। পুরুলিয়ার গ্রামে মেডিক্যাল ক্যাম্প। ছবিটি কয়েক বছর আগের, কিন্তু আবার কালজয়ীও।

চিকিৎসা। পুরুলিয়ার গ্রামে মেডিক্যাল ক্যাম্প। ছবিটি কয়েক বছর আগের, কিন্তু আবার কালজয়ীও।

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:২২
Share: Save:

১৯৭৩ সালে অন ইকনমিক ইনইকোয়ালিটি বইটি আপনি ডেডিকেট করেছিলেন দুই মেয়ে, অন্তরা ও নন্দনাকে। সেখানে আপনি এই আশার কথা লিখেছিলেন যে, দু’জনে যখন বড় হবে তখন তারা অনেক কম অসাম্য দেখবে, সেই অসাম্য যে ভাবেই মাপা হোক না কেন। আপনার আশা কি পূর্ণ হয়েছে?

একেবারেই হয়নি। শুধু আয়ের অনৈক্য নয়, যে জিনিসগুলো আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড়, সেগুলোর ক্ষেত্রে অসাম্য কমেছে, এটা বলা যাচ্ছে না। প্রগতি কিছু কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, দরিদ্রের সংখ্যাও নিশ্চয়ই কমেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা কমল, কতটা বাকি রইল। গোটা পৃথিবীর কথা যদি ভাবা যায়, কিছু কিছু দেশে অনৈক্য কমেছে, আবার অনেক জায়গায় বেড়েছে। যেমন, আয়ের অনৈক্য চিনে কমেনি, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, এগুলোর অসাম্য অনেকটাই কমেছে।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে তীব্র অসাম্য ছিল, এখনও আছে, কিন্তু কিছু কিছু দেশে তা কমেছে, যেমন ব্রাজিল...

ব্রাজিলে বহু দশক ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অসাম্য ছিল। ওরা সেটা অনেকখানি কমিয়েছে, তার পিছনে সরকারি পরিকল্পনার বড় ভূমিকা ছিল। মেক্সিকোতে সকলের জন্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা হয়েছে, ফলে সাধারণ অসুখবিসুখে মানুষ চিকিত্সা পাচ্ছে না, এটা আর হয় না, আমাদের দেশে যেটা সারাক্ষণ হচ্ছে। এটা ঠিকই যে, মেক্সিকোর মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, ফলে ওরা যতটা করতে পেরেছে আমাদের পক্ষে সেটা হয়তো কঠিন। কিন্তু ওরা আরও কিছু জিনিস করতে পেরেছে। যেমন, ব্যবসায়ীদেরও ওরা এই কাজে অনেকটা জড়িয়ে নিতে পেরেছে। আমাদের অনেকগুলো সমস্যা। প্রথমত, আমাদের আয় কম। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো সচরাচর এ বিষয়ে নজর দিতে একেবারেই উত্সাহী নয়। তৃতীয়ত, সরকার তাদের উপর কখনওই এই বলে চাপ দিচ্ছেন না যে, দেশের কল্যাণের জন্য এটা করো। সরকারের যথেষ্ট উদ্যোগ ছাড়া সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা কোনও দেশে সম্ভব হয়নি। ঠিক যেমন সরকারের সাহায্য ছাড়া সকলকে সাক্ষর করে তোলা গেছে, এটাও কোথাও হয়নি। একমাত্র ভারতবর্ষেই সরকার এমন একটা অসম্ভব জিনিসকে সম্ভব মনে করে ভুল পথে এগিয়ে যাবেন, এ-রকমটা মনস্থ করেছেন!

অসাম্য নিয়ে অনেক কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে। এ দেশে তুলনায় কম, ইউরোপ আমেরিকায় অনেক বেশি। কিন্তু সেখানে জোরটা প্রধানত আয়ের অসাম্যের উপরেই।

অসাম্য নিয়ে চর্চা এখন সত্যিই অনেকটা হচ্ছে। টমাস পিকেটির ক্যাপিটাল যেমন। খুব সুন্দর বই। কিন্তু এখানে প্রধানত আয় ও সম্পদের বৈষম্যের আলোচনা করা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে একেবারে ওপরতলার ধনীদের হাতে সম্পদ ও আয় কী ভাবে পুঞ্জীভূত হচ্ছে তার ওপর। সেটাও খুব দরকারি আলোচনা, কিন্তু ভারতে প্রধান সমস্যাটা হচ্ছে, জনপরিষেবার অবস্থা খুব খারাপ, ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার মতো ব্যাপারগুলোতে খুব বড় রকম অনৈক্য থেকে গেছে। পিকেটি যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন, এ দেশে কেবল আয়ের বৈষম্যের দিকে নজর দিলে চলবে না, জনপরিষেবার ঘাটতির দিকেও নজর দিতে হবে।

আমাদের দেশের নীতি রচনায় সুপরিকল্পনার অভাব আছে। যেমন বলা হচ্ছে, ওষুধের দাম কমানো হবে। সেটা ভাল, কিন্তু যাতে যথেষ্ট ভাল ডাক্তার থাকেন, চিকিত্সা ঠিক ভাবে হয়, সে দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। আনতাবড়ি ওষুধের প্রয়োগ বাড়ার ফলে টাকা খরচ বাড়ছে, কিন্তু স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে এটা বলা যাবে না।

বিশেষ করে গ্রামে ডাক্তারের ভয়ানক অভাব।

এটা একটা বড় সমস্যা। তাইল্যান্ডে এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য নিয়ম করেছে, ডাক্তারি পাশ করার পরে দুই বা তিন বছরে গ্রামে চিকিৎসার কাজ করতে হবে।

না করলে কী হয়?

একটা শাস্তির ব্যবস্থা হয় বলেই আমার ধারণা। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিরাট বাজার। ওখানে কিন্তু সরকারি চিকিত্সা ব্যবস্থাটাই প্রধান, ফলে ডাক্তাররা নিয়ম না মানলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্য পরিচর্যায় সরকারি খরচ তো প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম।

স্বাস্থ্য এবং শিক্ষায় আমাদের দেশে সরকারি খরচের বিরাট ঘাটতি। জাতীয় আয়ের খুব কম অংশই স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ হয়। আগের কংগ্রেস আমলেও সেটা কম ছিল, বিজেপি সরকার তো আরও কমিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি পরিষেবার ব্যবস্থাপনা নিয়েও চিন্তাভাবনার খুবই অভাব। তাই সামান্য যে অর্থ ব্যয় হয়, সেটাও ভাল প্রয়োগের ব্যবস্থা হয় না। তার একটা কারণ, এই ধারণাটা এ দেশে জোরদার যে, বেসরকারি চিকিত্সাতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটা আগেও ছিল, এখন আরও বেড়ে গেছে।

অথচ দক্ষিণ ভারতে তো অন্য রকম দেখেছি আমরা, কেরলে, তামিলনাড়ুতে...

কেরল, তামিলনাড়ু, উত্তর ভারতেও হিমাচল প্রদেশ, এগুলো ভাল দৃষ্টান্ত। সরকারি জনপরিষেবা যে করা যায়, তার অনেক প্রমাণ দেওয়া যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সুচিন্তার অভাব আছে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা যায়। বিজেপির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন হর্ষবর্ধন, যে মুহূর্তে একটু ঠিক ঠিক চিন্তার পরিচয় দিলেন এবং বললেন যে তামাক কোম্পানিগুলোকে দমন করবেন, অমনি তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল!

চিন্তা এবং ব্যবস্থাপনার এই অভাব তো ইদানীং আরও বেড়েছে...

এক, বেসরকারি চিকিত্সা ব্যবস্থার হাতে সব কিছু ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। দুই, সরকার যে সব খাতে খরচ করে, সেখানে সাধারণ মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যের চেয়েও জটিল যে সব চিকিত্সায় অনেক খরচ হয়, সেগুলোতে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। যেমন আরএসবিওয়াই (রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা)-এর মতো পরিকল্পনা, যার মূল ভাবনাতেই সমস্যা। প্রথমত, এই ব্যবস্থার জন্যে যে টাকা খরচ হচ্ছে, তা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে দেওয়া হলে অস্বাস্থ্যের অনেক সমস্যা আসতই না। তা না করার ফলে অসুখের জটিলতা বেড়ে যায়, খরচও বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, বিমার টাকাটা দেওয়া হবে হাসপাতালকে। এখন আমাদের দেশে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালকে বেশি ভরসা করেন। ইউরোপে এটা ভাবাই যায় না। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাকে এক বার একটি চিকিৎসার ব্যাপারে ইংল্যান্ডের এক ডাক্তার বলেছিলেন, ‘আপনার ব্যাপারটা যদি কম সিরিয়াস হত, তা হলে বলতাম আপনি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন, কিন্তু এটা এতটাই সিরিয়াস যে কেবল ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসই এটা দেখার ক্ষমতা রাখে।’ আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। লোকের ধারণা হয়েছে যে, বড় বড় বেসরকারি নার্সিং হোমেই শ্রেষ্ঠ চিকিত্সার ব্যবস্থা আছে। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোকে সবচেয়ে ভরসা করা যাবে, এটাই তো হওয়ার কথা।

সমাজের মাথায় যাঁরা, তাঁরা সরকারি হাসপাতাল থেকে সরে গিয়ে নার্সিং হোমে চিকিৎসা করাচ্ছেন, তাই সরকারি হাসপাতালের ওপর ভাল করার চাপও তো কমে যাচ্ছে। ঠিক যেটা হচ্ছে স্কুলের ক্ষেত্রেও।

ঠিকই, তবে এখানে একটা পার্থক্য আছে। যাঁরা স্কুলকলেজে ছেলেমেয়েদের পাঠান, তাঁদের অনেকেই অন্তত স্কুল সম্বন্ধে কিছুটা জানেন। কিন্তু চিকিত্সার ক্ষেত্রে— যেটাকে অ্যাসিমেট্রিক ইনফর্মেশন বলা হয়— যা জানার চিকিত্সকরা তা হয়তো জানেন, কিন্তু রোগী বা তাঁর বাড়ির লোক কেউই বিশেষ কিছু জানেন না। ফলে বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিং হোমেও যে সব সময় ভাল চিকিত্সা হয়, তা বলা যাবে না। তবুও, যাঁদের সামর্থ্য আছে, সরকারি হাসপাতালের কথা তাঁরা ভাবেন না, কারণ সেখানে খুবই অব্যবস্থা। আমাদের কম বয়েসে এটা ভাবা হত না, ভাবার কোনও কারণও ছিল না।

সাধারণ ভাবে, ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে তিনটে কথা বলার। এক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে অবহেলা করে বড় বড় হাসপাতাল নার্সিং হোম তৈরি করা, বড় বড় অসুখের চিকিত্সার দিকে বেশি মনোযোগ করা। বেশির ভাগ গরিব মানুষ তো ওই পর্যায়ে পৌঁছনোর আগেই খতম হয়ে যান। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের দিকে ভাল করে নজর না দিলে স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুব্যবস্থা কোথাওই করা সম্ভব নয়। দুই, এই ব্যবস্থায় চিকিত্সার টাকাগুলো যায় প্রধানত বেসরকারি হাসপাতালে। এখানে একটা স্বার্থগোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে, যাদের বড় রকমের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। তিন, অনেক সময় বেসরকারি হাসপাতালে অকারণ চিকিত্সা করিয়ে দেয়, কারণ সেখানে তদারকি করার কেউ নেই। যেমন অনেক হাসপাতালে টাকার জন্যে মেয়েদের হিস্টেরেকটমি করিয়ে দেয়, প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক।

চিকিত্সার গোটা ব্যবস্থাটা হওয়া দরকার সামগ্রিক মাপকাঠি মেনে, চিকিত্সকদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে, একটা সুপ্রতিষ্ঠিত মানকে লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে। তার পরে যদি ধনীদের জন্য বেশি মূল্য নিয়ে কিছু বাড়তি সুবিধের ব্যবস্থা করা হয়, সেটা চলতে পারে। কিন্তু বুনিয়াদি ব্যবস্থাটা হবে পাকা রকমের, এবং সেটা চালানোর দায়িত্বে থাকবেন যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য মেডিক্যাল অফিসাররা, যে ভাবে হোক টাকা করাটাই যাঁদের একমাত্র লক্ষ্য নয়। ১৯৫৪ সালে যখন প্রথম ইটালি গেলাম, তখন দেখেছি, ওদের চিকিত্সার ব্যবস্থা বেশ দুর্বল। এখন তো ইটালিতে স্বাস্থ্য পরিচর্যার চমত্কার আয়োজন। সেটা ওই নির্ধারিত চিকিত্সক এবং নার্সদের সাহায্যেই তৈরি করা হয়েছে। আর একটা কথা হচ্ছে, আমাদের নার্সিংয়ের মান প্রচণ্ড খারাপ।

প্রশিক্ষণের অভাব...

সেটা তো আছেই, জনকল্যাণের কাজে যে মানসিকতাটা দরকার, অনেক সময় তারও অভাব দেখা যায়। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সাধারণ ভাবে ব্যবস্থাটা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। চিকিৎসার সঙ্গে অর্থ আহরণ করাটা অতিমাত্রায় জড়িত হয়ে গেছে।

সমাজ এবং রাষ্ট্র, দু’দিক থেকেই একটা সমদৃষ্টির অভাব আছে।

ভীষণ রকম অভাব আছে। এইটেই কিন্তু মোদ্দা কথা। রাষ্ট্র এবং সমাজ, দুটোর মধ্যেই এই সমদৃষ্টির অভাব দূর করতে হলে একটা বড় রকমের পরিবর্তন দরকার। প্রথমত, স্বাস্থ্যের জন্য টাকা বেশি বরাদ্দ করা দরকার। দ্বিতীয়ত, সেই টাকাগুলো আরএসবিআই ইত্যাদি ভুল খাতে না ঢেলে সুচিন্তিত ভাবে ব্যয় করা দরকার। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য পরিচর্যার কাজে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের মানসিকতার একটা পরিবর্তন খুবই জরুরি। আমাদের সব কিছুই একটা ব্যবসায়িক সমাজের মতো হয়ে গেছে, কে কোথা থেকে টাকা করতে পারে সেটাই একমাত্র বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য কোনও কমিটমেন্ট যে থাকতে পারে, সেই উপলব্ধি একেবারে কমে গেছে। কমিটমেন্ট নিয়ে আমরা কেবল খুব জমিয়ে বক্তৃতা দিই। লালকেল্লা থেকে পনেরোই অগস্ট মোদী বলে দিলেন, দেশের সবার বাড়িতে শৌচাগার হবে। সেটা হল কি না হল, দেখার কেউ নেই। এখনও ভারতের প্রায় সব ক’টা শহরেই বাড়ি তৈরি করা যায়, যেখানে পরিচারকদের বাসস্থান আছে কিন্তু শৌচাগার নেই। আইনে একটা সামান্য পরিবর্তন করলেই এই ব্যবস্থাটা করা যায়, কিন্তু সেটা করা হয়নি।

এখানে কি সামাজিক আন্দোলনের একটা ভূমিকা থাকতে পারে না? এ ধরনের বিষয়ে তেমন আন্দোলন কিন্তু এ দেশে কমই দেখি।

সামাজিক আন্দোলনের একটা ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে একটা সুচিন্তার খুব বড় রকমের প্রয়োজন আছে। যেমন সম্প্রতি একটি খবরের কাগজে পড়লাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মধ্যে দলিতের সংখ্যা খুবই কম। এটা সত্যিই একটা বড় সমস্যা। দলিতদের মধ্যে যদি যথেষ্ট শিক্ষিত ও উপযুক্ত কেউ থাকেন তা হলে তাঁদের হেয় করা হলে আমাদের খুবই প্রতিবাদ করা উচিত, সে দিক থেকে সামাজিক আন্দোলনের খুবই মূল্য আছে। কিন্তু অন্য দিকে যদি বলা হয়, শিক্ষিত হোক বা না হোক, কোটা করে শতকরা এত জন দলিতকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতেই হবে, তা হলে কিন্তু ভুল করা হবে। সমস্যাটা তো এই যে, আগে তাঁদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। অতএব তাঁদের পক্ষে ভাল মাস্টারি করা তো সম্ভব না। এটা বলতে গেলেই অনেকে আবার বলতে পারেন, এ তো এলিটিস্ট কথাবার্তা হল। তা, এর মানে যদি এলিটিস্ট হয়, তবে সেটার তো এখানে প্রয়োজন আছে, ভাল শিক্ষা তো দরকার। অন্য দিকে, দলিত ছাত্রদের কোটা করে হোক, যে করে হোক, লেখাপড়া শেখানো হোক, সেটা খুবই দরকার। সেটা না হলে কোনও যথার্থ পরিবর্তন হবে না। কিন্তু সেই শিক্ষার ব্যবস্থা না করে, বা তার আগেই, অযোগ্য দলিতদের মাস্টারি করতে দেওয়া মানে শিক্ষার মান কমিয়ে দেওয়া। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, তার মধ্যে একটা সুচিন্তিত পার্থক্য করা দরকার। আমাদের আন্দোলনে অনেক সময় ভাল মন্দ এমন একসঙ্গে চলে যে, তাতে হিতে বিপরীত হয়।

যেমন আর একটা ব্যাপারে আমি কিছু দিন ধরে বলার চেষ্টা করছি। আমি তো নিজেকে বামপন্থী মনে করি। কিন্তু আমাদের দেশের বামপন্থীরা একটা পথ নিয়েছেন যে, ‘শিল্প উঠে যাক, কিন্তু আমাদের ইউনিয়নের দাপট রাখতে হবে।’ এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। শ্রমিকদের অনেকগুলো অধিকার থাকতে হবে, অসাম্য কমানো দরকার— এগুলো নিশ্চয়ই মানব, কিন্তু তা করতে গিয়ে যদি শিল্পগুলোই উঠে যায়, তা হলে ওই অসাম্য কমানোর পরিমণ্ডলটাই হারিয়ে যাবে। এ বিষয়ে মার্ক্সের সুন্দর আলোচনা আছে। তিনি বলছেন, উত্পাদন আর বণ্টন, দুটিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না এবং বণ্টনের খাতিরে আমরা যদি উত্পাদনকে অবহেলা করি, তা হলে শেষ পর্যন্ত সেটা আমাদের সাহায্যে আসবে না। বণ্টন নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাকে কখনওই উত্পাদন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। মার্ক্সবাদীরাই যদি এটা ভাবার চেষ্টা না করেন, তা হলে আমাদের আক্ষেপের কারণ আছে।

তাঁরা তো চিন্তার নানা সুযোগ পেয়েছেন...

অর্থনীতিতে অলৌকিক চিন্তার অভাব নেই। সেটা প্রধানত দক্ষিণপন্থীদের থেকেই আসে। যেমন ওই যে বলছিলাম, চিকিত্সার কোনও ব্যবস্থাই যেখানে নেই, রুগিরা জানেন না কী অসুখে তাঁরা ভুগছেন, সেখানে বেসরকারি ব্যবসায়ী লাভ করতে নেমে তাঁদের সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করবেন, এটা অলৌকিক চিন্তা। পৃথিবীর কোথাও এমনটা হয়নি এবং পৃথিবীর বাইরেও কোথাও হয়েছে বলে আমি শুনিনি, অতএব একেবারেই অলৌকিক বলতে হবে। এটা গেল দক্ষিণপন্থী চিন্তার কথা। কিন্তু বামপন্থী ভাবনাতেও কিছু কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, শিল্প উত্পাদনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সমতা আনা যেতে পারে, এ বিষয়ে অনেক দিন ধরে অনেকে লিখেছেন, তাঁরা সবাই যে খুব বামপন্থী এমনও নয়। কিন্তু এখনও অবধি মোটামুটি যেটা কাজ করেছে, সেটা হচ্ছে একটা স্বাভাবিক ব্যবসা। স্বাভাবিক ব্যবসার উন্নতি করার অনেক সম্ভাবনা আছে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি ব্যবসাটাকেই তুলে দেওয়া হয়, সেই ক্ষতি পূরণ করা খুব সহজ হবে বলে আমি মনে করি না। সুতরাং আমাদের একটা কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োজন।

এখানে আমি মার্ক্সকেই আবার স্মরণ করব। ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত, তাঁর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই, ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম, তাঁর শেষ বইও। সেখানে তিনি জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিকে বলছেন, তোমরা বলছ, সবাইকে কাজের উত্পাদনশীলতা অনুসারে মজুরি দেওয়া হবে, এটাই সাম্য। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে তার উত্পাদনশীলতার তারতম্য থাকতেই পারে। তাই আমাদের এটা মানতে হবে যে, উত্পাদনশীলতা অনুসারে মজুরি দেওয়া হলে সেটা পুঁজিবাদের থেকে একটা উন্নতি হল বটে, কিন্তু এখানেই আমাদের থামলে চলবে না, প্রয়োজন অনুসারে বণ্টনের কথাও ভাবতে হবে। তার পরেই মার্ক্স বলছেন, কিন্তু সেই প্রয়োজনানুগ বণ্টন কি এখন সম্ভব? তিনি নিজেই বলছেন, না, সম্ভব নয়। জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি যা বলছেন, সেটা আমি মেনেই নিচ্ছি, কিন্তু এটাতে আমাদের সন্তুষ্ট হলে চলবে না, মনে করলে চলবে না যে ‘যা যা করণীয় সব করে ফেললাম’, কেননা আমাদের বড় উদ্দেশ্য এখনও বাকি রইল যে, প্রয়োজন অনুসারে বণ্টন কবে করা যায়। অর্থাত্, এক দিকে, সেই আদর্শ আছে বলে, এখনকার ব্যবস্থায় যেটা করা অসম্ভব সেটা না করা আর অন্য দিকে, সেই আদর্শ অবস্থাটায় কোনও দিন পৌঁছতে হবে, এই কমিটমেন্টটা রাখা— এই ডুয়ালিটিটা আমার মতে ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম-এর সবচেয়ে বড় জিনিস। আমি একে বামপন্থীর রাজনীতির একটা খুব বড় কথা বলেই মনে করি। মার্ক্স জার্মানির তখনকার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, কিন্তু আমাদের আজকের প্রেক্ষিতেও কথাটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

২০১৪ সালে একটি সাক্ষাত্কারে চিন ও ভারতের তুলনা করে আপনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টনের দিক থেকে দেখলে চিনের তুলনায় ভারতে অসাম্য বেশ কিছুটা কম। ভারতের এই রাজনৈতিক গণতন্ত্র তার অর্থনৈতিক অসাম্য কমানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি কেন?

এটা ঠিকই যে চিনে প্রাথমিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অনৈক্য কম। ওপরের দিকে অনৈক্য অবশ্যই আছে। যেমন, সাংহাইয়ে ওপরের সারির স্কুলগুলিতে শিক্ষার মান দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল, ‘পিসা’ নামে যে আন্তর্জাতিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা আছে, তাতে এখন সাংহাই দক্ষিণ কোরিয়ার সিয়োলকেও হারিয়ে দিয়েছে। তা, এই ধরনের স্কুলে পড়ার সুযোগ তো সমাজের খুব উঁচু স্তরের পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পায়। কিন্তু প্রাথমিক স্তরে কেউ শিক্ষা পাচ্ছে না, প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, এটা সেখানে নেই। এক বার ওখানে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম, প্রাথমিক শিক্ষায় প্রাইভেট টিউশন ব্যাপারটা কী, বোঝাতেই খুব মুশকিল হল— ওরা ধরতেই পারছে না, শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে প্রাইভেট টিউশনের প্রয়োজন কেন হবে! তা হলে স্কুলে কী শেখানো হল!

কিন্তু অন্য দিকে, আমাদের দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা যতটা আছে, চিনে তো ততটা নেই। আমাদের স্বাধীনতাও অনেক সময় খর্বিত, আগের তুলনায় ইদানীং কমে গেছে সেটাও ঠিক, সে বিষয়ে আমাদের অভিযোগ করার আছে, আন্দোলন করার আছে। কিন্তু এখনও তো আমরা সহজেই বলতে পারি যে সরকার ঠিক করছেন না। এমনকী এটাও বলা যেতে পারে যে সুপ্রিম কোর্ট ঠিক করছেন না। এই স্বাধীনতাকে আমি নিশ্চয়ই মর্যাদা দিই। কিন্তু অন্য দিকে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি পূরণ করার ক্ষেত্রে চিনের অবস্থা আমাদের থেকে অনেক ভাল।

প্রশ্ন হল, আমরা কি গণতন্ত্র রেখেও এই সব বিষয়ে চিনের সমকক্ষ হতে পারি? এর উত্তর হচ্ছে, কেন পারব না? এটা ঠিকই যে, ওদের পক্ষে খুব সজোরে সবেগে একটা কাজ করা সম্ভব। যদি ওপরের দিকে বারো জন বা চোদ্দো জন কোনও বিষয়ে একমত হলেন, তা হলেই সেটা তাঁরা করতে পারেন। কিন্তু আমাদের এখানে এগুলো করতে গেলে অনেক সময়েই একটা জন-আন্দোলনের প্রয়োজন আছে। খবরের কাগজগুলোর, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর একটা ভূমিকা আছে। এবং তার সঙ্গে এটা স্বীকার করার প্রয়োজন আছে যে, আমরা যদি এই জিনিসগুলো না চাই তা হলে পাব না। এই চেষ্টাগুলো করলে আমরা গণতন্ত্রের সত্যিই সুযোগ নিতে পারি।

এমন যে হয়নি তা নয়। ব্রাজিল নিয়ে কথা হচ্ছিল। ব্রাজিলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির যে উন্নতি এল, সেগুলো কী করে এল? গণতন্ত্রের সাহায্যেই তো এল। সামরিক শাসন চলে যাওয়ার পরে লোকে ভীষণ রকম প্রতিবাদ করলেন যে, কেন দেশে এ রকম অসাম্য আছে, কেন আমাদের সবার সুচিকিত্সার ব্যবস্থা নেই, কেন আমাদের শিক্ষার মান এত খারাপ। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই সমস্যাগুলোর অনেকটা সুরাহা হল। সেটা তো গণতন্ত্রের অভাবে এল না, তার সাহায্যেই এল। আমাদেরও ঠিক সেটাই করা দরকার।

চিনের মতো দেশের আর একটা সমস্যা হল, তাঁরা অনেক কিছুই ঠিকঠাক করছেন, কিন্তু যদি কোনও একটা দিকে বড় ভুল করেন, তা হলে একটা বড় বিপর্যয় হতে পারে, যেমন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ একটা বিরাট দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, কিংবা ১৯৭৯ সালের পরে হঠাত্ নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র না থাকলে সব সময়েই এ ধরনের ভুলের একটা ঝুঁকি থাকে, একটা জুয়ো খেলার মতো— এই মুহূর্তে চিনেরা খুব ভাল খেলছেন, কিন্তু হঠাত্ একটা বিরাট গোলমাল হয়ে যেতে পারে।

তবে চিনের লোকেরা কিন্তু শিক্ষা এবং সংস্কৃতির নানা ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী। সে দেশেই জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মিউজিয়মে যান। বই পড়ার উত্সাহও সেখানে খুবই জোরদার।

শিক্ষার প্রতি এতটা আগ্রহ, এত বই পড়া, তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য চাহিদাটা চিনে এখনও এত কম দেখা যায় কেন?

এটা একটা বড় প্রশ্ন। হতে পারে, সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রনেতা লি কুয়ান ইউয়ের কথাটার একটা যুক্তি আছে যে, ওই অঞ্চলের মানুষের মূল্যবোধে কনফিউসিয়াসের একটা বড় রকম প্রভাব আছে, শৃঙ্খলাটা এত জোরালো যে গণতন্ত্রের বিষয়ে সবারই একটা সন্দেহ আছে। আবার এটাও হতে পারে, যে ওখানেও বহু লোকেই গণতন্ত্র চান, কিন্তু দেশের অর্থনীতির একটা মোটামুটি ভাল রকম প্রগতি হয়েছে এবং সেটা বেশ ভঙ্গুর, একটু ধাক্কা মারলেই ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আপসেটিং দ্য অ্যাপল কার্ট’, তেমনটা ঘটে যেতে পারে, সেই জন্যেও ওঁদের একটু উদ্বেগ আছে। চিন হচ্ছে বিপ্লবের দেশ। মাও ৎসে তুং দুনিয়ার এক জন বড় বিপ্লবী। তার পরে কালচারাল রেভলিউশন, ও দেশের মানুষ সেটার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তাঁরা ভয় পেয়ে গেছেন যে ভাল ভাল চিন্তার থেকে এত অত্যাচার কী করে হতে পারে! তাই হয়তো ওঁরা পরিবর্তনের ব্যাপারে খুব সাবধানে চলতে চান। কিন্তু আমার ধারণা, চিনে এরই মধ্যে গণতন্ত্র ক্রমশ পাকা হবে।

চিনে গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে যে অসাম্য বেড়েছে, এ নিয়ে ওঁদের ছাত্র, শিক্ষক, নাগরিকদের মধ্যে খুব কোনও চিন্তা আছে?

উদ্বেগ আছে। আমি ওখানে এই অসাম্য বৃদ্ধি বিষয়ে অনেক ক’টা সেমিনারে যোগ দিয়েছি। সে নিয়ে কিন্তু সরকার ওদের আলোচনা করতে দেন। (চলবে)

সাক্ষাৎকার: অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE