Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ২

আমার দিন কাটে না

তা হলে কি বোর করাই ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী নৃশংসতম শাস্তি? উফ, বড় হাঁ করে কাঁদতেও পারি না, হাসপাতাল তো, জার্ম ঢুকে যাবে।এর চেয়ে তো ঘানি টানা ভাল ছিল রে! এ তো শুধু বোর করে মেরে ফেলবে! কেউ নেই কিচ্ছু নেই, একটা এসি কেবিনে সারা দিন মাথা ঠুকে মরছি। হাসপাতালে থাকলে প্রাণটা এমনিতেই হু হু করে। কখন ভিজিটিং আওয়ার বাজবে। চারটে লোক এট্টুখানি বাইরের বাস্তবের টাচ আনবে। আর এ তো আসলে জেল-কাম-হাসপাতাল। ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনাই দিগন্তে নেই। তা, একদম একা একলা অ্যালোন পড়ে যাওয়া লোকটাকে একটু সঙ্গ দিতে কেউ আসবে না! রোগের চিকিৎসা শুধু অ্যালোপ্যাথি না রে ভাই, সিমপ্যাথি ভি চাই।

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

এর চেয়ে তো ঘানি টানা ভাল ছিল রে! এ তো শুধু বোর করে মেরে ফেলবে! কেউ নেই কিচ্ছু নেই, একটা এসি কেবিনে সারা দিন মাথা ঠুকে মরছি। হাসপাতালে থাকলে প্রাণটা এমনিতেই হু হু করে। কখন ভিজিটিং আওয়ার বাজবে। চারটে লোক এট্টুখানি বাইরের বাস্তবের টাচ আনবে। আর এ তো আসলে জেল-কাম-হাসপাতাল। ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনাই দিগন্তে নেই। তা, একদম একা একলা অ্যালোন পড়ে যাওয়া লোকটাকে একটু সঙ্গ দিতে কেউ আসবে না! রোগের চিকিৎসা শুধু অ্যালোপ্যাথি না রে ভাই, সিমপ্যাথি ভি চাই। আমার আবার ওটাই বেশি চাই, অসুখ তো তেমন হয়নি। বোধহয় দুশো দিন হয়ে গেল, এই দশা চলছে। না কি তিনশো? অংকের হিসেব হয়তো বলবে, একশো বাহান্ন। কিন্তু পাতি-অংক দিয়ে জীবন চলে? থিয়োরি অব রিলেটিভিটি কী বলে? যদি বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকো, তখন দু’মিনিটই বাইশ ঘণ্টা। ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে ঢলাঢলি করো, ছ’ঘণ্টাও আড়াই সেকেন্ড। আমার তো মনে হয় পঁচাশি বছর ধরে হেজেমজে একটা কুয়োয় পড়ে আছি। তা হলে কি বোর করাই ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী নৃশংসতম শাস্তি? শয়তানগুলো মিলে ষড় করে আমাকে ঘুরপথে হেভি কড়া পানিশমেন্ট দিল? উফ, বড় হাঁ করে কাঁদতেও পারি না, ইমেজের ব্যাপার আছে। তা ছাড়া হাসপাতাল তো, জার্ম ঢুকে যাবে।

মাইরি, এত বড় একটা সংগঠন— একটা লোকেরও সক্কালে উঠে মনে পড়ে না, এক দুর্দান্ত সহযোদ্ধা মাসের পর মাস মনমরা হয়ে বসে দেওয়ালের চুনকাম মুখস্থ করছে! রাজনীতি কি মানুষকে আপন করতে শেখায় না? অন্য দলের লোককে নিশ্চয় পুঁতে দেব, ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে ঘোরাব, মিথ্যে দোষ দিয়ে জুতোর মালা পরাব, একঘরে করে ধোপা-নাপিত বন্ধ করব। কিন্তু নিজের দলের মানুষকে কোলের কাছে বসিয়ে অল-টাইম ফুচকা খিলাব না? জিগাব না, এক্সট্রা তেঁতুলজল নিবি বাছা? তা হলে কোন ছারের পলিটিক্‌স? কীসের পাশাপাশি লড়াই, সংগ্রাম, বিপ্লব? এর গায়ে ফোসকা পড়লে ও বার্নল লাগায় আর ও ঘুষ খেয়েছে শুনলে এ আহ্লাদে বিদেশি গাড়ি কিনে ফেলে, সব ভুয়ো? মেকি? প্রথম যখন ধরা পড়লাম, স্টেজ বেঁধে হল্লা করে সাপোর্ট দেওয়া হল। কিন্তু বাবা, যে কোনও ক্রাইসিসে প্রথম-প্রথম উত্তেজিত হয়ে হাত-পা ছু়ড়তে সবাই পারে। আসলি বন্ধুর কাজ হল, দীর্ঘ লড়াইয়ে পাশে থাকা। সারা রাত জেগে জলপট্টি দেওয়া। বেশি কিছু তো চাইনি, সোনা না, দানা না। শুধু একটু আয়, মিথ্যে হলেও বল: কাল জামিন শিয়োর। পায়ের কড়ে আঙুলে গোমেদ পরার সাজেশন দে। তার পর অন্ত্যাক্ষরী খেললি হয়তো দু-দশ মিনিট। এই তো। আরে, গরম পড়েছে, আম উঠেছে, দুটো টুকটুকে গোলাপখাস দেওয়ার অজুহাতেই ঢুকে পড় না। তা না, বয়কট! আর তা-ও কাকে? যে কিনা তোরা মেলোড্রামিয়ে নিজ দুর্দশার কথা বলতে না বলতে ফুঁপিয়ে উঠে আংটি খুলে দিয়ে দিয়েছে!

এই উইথড্রয়াল এফেক্ট-টাই সাংঘাতিক! সকাল থেকে বাড়িতে শয়ে শয়ে চেলাচামুন্ডা, হাত-কচলানো কান্নামুখো পাবলিক, দুরন্ত তেল-মারা মসৃণ মোসায়েব, এমনকী ফেরে পড়ে ভজতে আসা সন্তপ্ত সিপিএম! আর কাজটা কী ইজি! এই রক্তদান শিবিরে দিদির ভজনা করে বক্তিমে দিলাম, তাপ্পর ফট করে গরিব বিধবাকে পেনশনের ব্যবস্থা জুগিয়েই, দেড়ো আর্টিস্টের সঙ্গে গম্ভীর মিটিং: এ বারে পুজোর প্যান্ডেলের থিম কী হবে। আর ফি সন্ধেবেলা? রইস হোটেলে ডাঁয়েবাঁয়ে ইয়ার-বক্সি নিয়ে লে ঢকাঢক! ওঃ, নিজেকে মনে হত একটা ইতিহাস-টকটকে রাজা! অন্য ছন্দে পা ফেলতাম। যেন ধরিত্রীকে ভাল স্পা-তে এনে ফুট মাসাজ করে দিচ্ছি। সেই জন্যে ভাল জাতের স্নিকারও ছিল। সে স্নিকারের মৃদু লাথ খেলেও লোকে ধন্য হয়ে বাড়ি বয়ে ভেলি গুড় দিয়ে গেছে। একটু স্লিপারি, কিন্তু ভাল খেতে।

আর ফিলিমের লোক? উরেবাপ, আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে অস্থির! আমাদের দলের পলিসিই হল সিরিয়াল আর সিনেমার চাঁইদের তোল্লাই দেওয়া। যাতে হাঁ-করা গাঁইয়াদের হিস্টিরিয়া পাওয়া যায়। আর ফিলিমওলাদের অভ্যেসই হল ক্ষমতার ছায়ায় হ্যাহ্যা-ল্যাল্যা। দুইয়ে দুইয়ে চার ফেলতেই সব ব্যাটা তুরন্ত ফেশিয়াল করে মিছিলে মিটিঙে। কিন্তু এখন? দেখা করতে আসবে কী করে? আমার যে ছোঁয়াচে অসুখ! ওদের গ্ল্যামার-ত্বকে সিবিআই হয়ে যাবে!

মাঝে মাঝে মনে হয়, এই সারা দিন ফ্ল্যাশব্যাক মোডে কাটানোর চেয়ে, জেলে ফিরে যাই। হরেক লোক, গুচ্ছের কথাবার্তা। কিন্তু একটা শয়তান কয়েদি এক বার বহুত হাবিজাবি গাল দিয়েছিল। আবার মনে হয়, এক দিন না এক দিন তো ছাড়া পাবই, তখন বায়োডেটা-য় যত কম হাজতের কথা লেখা থাকে ততই ভাল। বাইরেও তো আওয়াজ দেওয়ার লোকের অভাব নেই! মিডিয়া যে মার্কশিট বানাবে তাতে কুণাল ঘোষের ওপর তো থাকতে হবে রে বাবা!

কিন্তু কুণাল একটা কথা ঠিক বলেছে। বড়কা বড়কা স্ক্যাম করে সব্বাই জামিন পেয়ে যাচ্ছে, তা হলে আমরা পাব না কেন? এই দেখো, সলমন খান গাড়ি নিয়ে ঝামেলি করল, জামিন পেয়ে গেল। আবার মেয়রের ভাইঝি গাড়ি নিয়ে ঝামেলি করল, মহাজনের টায়ারের ছোপ মেনে তাকে ছেড়ে তো দেওয়া হলই, পুলিশকেই কোঁতকা লাগানো হল। তার মানে, এক টাইপের বখেড়ায় পৃথক হ্যারাসমেন্ট হয় না। অবশ্য এ থিয়োরি ভাবতে গিয়ে বুক ধড়ফড় বেড়ে যায়। তবে কি ওরা ভেবেচিন্তে ঠিক করেছে, কুণাল আর আমার একই হ্যারাস-কোষ্ঠী? ওকে ছেঁটে যেমন আমোদে তুড়ুক নেচেছিলাম, আমাকেও কি ফুসুরফুসুর বোঝাপড়া করে রান-আউট করে দিল? রাজায় রাজায় চুক্তি হয়, মন্ত্রী-বাগড়া’র প্রাণ যায়!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE