Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আরও কিছুখন

কে বলতে পারে, সমাজ-পরিজন-প্রতিবেশী মন থেকে ‘যেতে নাহি দিব’ বললে হয়তো মৃত্যুপথযাত্রী রোগীও আরও বাঁচতে চাইত?আজ আমরা জীবনমৃত্যুর ভাগাভাগিটাকে চরম জায়গায় নিয়ে যেতে শিখেছি। আগে এই বিভাজন অতটা ছিল না। জীবনবোধ আগেও ছিল, মৃত্যুবোধ ছিল। কিন্তু এ দুইয়ের মাঝে এক অতীন্দ্রিয় জগত্‌ ছিল। আজও আছে, কিন্তু এক স্থূল বস্তুবাদের প্রভাবে আমাদের মধ্যে এই অতীন্দ্রিয় বোধ ক্রমশ লোপ পাচ্ছে।

রণবীর সমাদ্দার
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

আজ আমরা জীবনমৃত্যুর ভাগাভাগিটাকে চরম জায়গায় নিয়ে যেতে শিখেছি। আগে এই বিভাজন অতটা ছিল না। জীবনবোধ আগেও ছিল, মৃত্যুবোধ ছিল। কিন্তু এ দুইয়ের মাঝে এক অতীন্দ্রিয় জগত্‌ ছিল। আজও আছে, কিন্তু এক স্থূল বস্তুবাদের প্রভাবে আমাদের মধ্যে এই অতীন্দ্রিয় বোধ ক্রমশ লোপ পাচ্ছে।

উন্নততর সমাজে দয়া সহানুভূতি মায়া মমতা সহমর্মিতা আরও বেশি থাকবে। অর্থ ও ব্যক্তিসর্বস্বতার মাপকাঠিতে যেহেতু জীবন বা মৃত্যু কোনওটারই নির্দয় বিচার হবে না, তাই কারও চলে যাওয়াকে আমরা মায়ামমতা দিয়ে বেশি করে দেখব। চিকিত্‌সাশাস্ত্রের নির্দয় নিয়ম দিয়ে নয়। স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘দুয়ারটুকু থাক’ (১৮-১) পড়ে খুব ভাল লেগেছিল,তবু উপরোক্ত কারণে বলব, চিরন্তন কাল মানুষ যেন বলতে পারে ‘যেতে নাহি দিব’।

যেতে নাহি দিব এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে জীবন-মৃত্যু বোধ কি নেই? আছে, কিন্তু তাকে ছাপিয়ে আছে নৈকট্যের উষ্ণতা, তার অমোঘ আকর্ষণ, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাকে পরাস্ত করার তীব্র কামনা। মানবিক বোধের যে অতীন্দ্রিয় দিক, তার অন্তর্গত এই আকাঙ্ক্ষা বা কামনা। ধনতান্ত্রিক সমাজ জীবন-মৃত্যুকে ব্যক্তি-অধিকারে পর্যবসিত করতে চায়। সেখানে অতীন্দ্রিয় বোধের কোনও স্থান নেই, ‘যেতে নাহি দিব’ বলার অধিকার নেই। কে বলতে পারে, সমাজ-পরিজন-প্রতিবেশীর কাছ থেকে এই আকর্ষণ উপলব্ধি করলে হয়তো মৃত্যুপথযাত্রী রোগীও আরও বাঁচতে চাইত? যে ক’দিন বাঁচি, জীবনকে বোধ করে, পূর্ণ মাত্রায় উপলব্ধি করে বাঁচি এই আকাঙ্ক্ষা রোগীকে, এমনকী মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকেও হয়তো নতুন মানসিক বল জোগাতে পারে।

আধুনিক চিকিত্‌সাশাস্ত্রে যত্নের স্থান হয়তো সামান্য। ওটা আয়া-পরিচারিকার বিষয়। রোগীর নিরাময়ে লাভের ক্ষেত্রে যত্নকে আমরা প্রধান গুরুত্ব দিই না। চিকিত্‌সকরা আরও কম গুরুত্ব দেন, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা এ বিষয়ে অজ্ঞ। তাঁদের লোকজনের যত্ন ও পরিচারক-পরিচারিকার সতর্ক নজর বহু যোজন দূরে। যে ক্ষেত্রে একটু দীর্ঘ এবং মধ্যমেয়াদি কড়া ওষুধের শিকার হতে হয় কোনও রোগীকে, সেখানে হয়তো পরিবর্তে পথ্য জীবনকে অনেক সহনীয় ও কাম্য করে তুলতে পারে। একাধিক ধরনের অসুস্থতা আছে, যেখানে সেবারত নিকটজন বা পরিচারক-পরিচারিকার সতর্ক দৃষ্টি বলে দেয়, কী করলে অসুস্থ মানুষ আরাম পাবে, ভাল বোধ করবে। চিকিত্‌সকরা কি এ-সব বোঝেন না? তাঁরা বোঝেন, কিন্তু তাঁরা রোগের নিরাময় করতে অভ্যস্ত, অসুস্থতার প্রতিকারে নয়। অসুস্থতা ও রোগ এক বিষয় নয়। এ দুইয়ের মাঝে সম্পর্ক আছে বইকী। কিন্তু পার্থক্য বোঝাও দরকার।

আইসিইউ-তে রোগীকে যেতে হয় অনেক সময় আধুনিক চিকিত্‌সাশাস্ত্রের পরিণামে। কড়া ওষুধ দিতে দিতে শরীর আর ওষুধের বশ হতে চায় না। রোগী হাসপাতালে ঢোকে এক কারণে। হাসপাতাল ব্যবস্থার মধ্যে যে অযত্ন ও অসতর্কতা, তার ফলে রোগী হাসপাতালে থাকাকালীন জীবাণু সংক্রমণের শিকার হয়। উপযুক্ত পথ্য ও পরিচর্যা বা সেই সংক্রান্ত উপদেশ থেকে বঞ্চিত রোগীকে শেষে প্রবেশ করতে হয় আইসিইউ নামক মৃত্যুকক্ষে, যেখানে তখন চিকিত্‌সকরা বলেন, আত্মীয়রা কেন বোঝেন না যে রোগী আর বাঁচবে না? তখন আমরা বলতে শুরু করি, স্বেচ্ছামৃত্যুর এবং এই ধরনের রোগীর প্রাণদীপ নির্বাপনের অধিকার ডাক্তার ও নিকটাত্মীয়রা প্রয়োগ করুক।

অর্থভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অন্য ভয়াবহ দিকও প্রত্যক্ষ করেছি। মুমূর্ষু রোগীর দিকে তাকিয়ে কেতাদুরস্ত বন্ধু অথবা এক আত্মীয় হয়তো চিকিত্‌সককে প্রশ্ন করেছেন, রোগী তো সারবে, কিন্তু নিরাময়ের পর কোয়ালিটি অব লাইফ-এর কী হবে? এই জীবন্মৃত জীবনে লাভ কী? সেরে ওঠার পরে রোগীর জীবনের মান কি আর বলার মতো থাকবে?

ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং স্বার্থকেন্দ্রিক সমাজে এ এক অমোঘ এবং আকর্ষণীয় প্রশ্ন। যত আমরা সম্পদ-বৈভবে বাড়ব, এই ভাবে ভাবার আকর্ষণ ততই দুর্বার হবে। অন্যের জীবনের মান কী, সেই বিচারে আমরা তত মগ্ন হব।

এমন ভাবনায় এক ধরনের জৈবিক রাজনীতির ছাপ আছে। আর একটু এগিয়ে বলা যায়, নাত্‌সি দর্শনেরও ছায়া। বছর কয়েক আগে ওলডেনবুর্গ নামে এক জার্মান শহরের পুর ভবনে বক্তৃতা দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভবনটি প্রতিষ্ঠিত হয় যুদ্ধোত্তর যুগে পুরনো এক হাসপাতালের বাড়িতে। অনুষ্ঠানের আগে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম একটার পর এক কক্ষ। কক্ষগুলি পরিচিত, সেখানে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ক্রমনিম্নগামী জীবনমান অনুযায়ী। বৃদ্ধ, ইহুদি, অঙ্গহীন যুদ্ধফেরত সেনানী, বন্ধ্যা নারী, বিকারগ্রস্ত মানুষ, অবসাদের শিকার যুবক সবাই মৃত্যুর জন্য চিহ্নিত। কেউ আগে, কেউ পরে। যার জীবনের মূল্য যত কম, সে তত তাড়াতাড়ি মৃত্যুশিবিরের পথে রওনা দেওয়ার জন্য চিহ্নিত।

এর চেয়েও বড় কথা, যে রোগীর জীবনমান সম্পর্কে আর বলার মতো কিছু নেই, তার যদি নিজের বিচার-আকাঙ্ক্ষা থাকে, তার কী হবে? বাঁচার আকাঙ্ক্ষা সম্ভবত স্বতঃস্ফূর্ত কোনও প্রবণতা নয়, হয়তো পরিবার, সমাজ, কৌম, স্বামী, স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, অর্থবন্ধন এই সবের কাঠামোয় বাঁধা এক আকাঙ্ক্ষা। রোগীর বাঁচার আকুলতার কী হবে এ বিষয়ে হাসপাতাল, চিকিত্‌সা বিজ্ঞান, চিকিত্‌সকের প্রাসঙ্গিকতা কম।

সেবা এবং পথ্যের ভূমিকা অনেক বেশি। চিকিত্‌সকরা এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞাত নন। কেউ কেউ ঠিক উপদেশ দেন, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে চিকিত্‌সা ও যত্নের এখনও সেতুবন্ধন হয়নি। ওষুধ এবং পথ্য, নিরাময় ও সেবা এখনও দু’টি ভিন্ন জগতের বিষয়। মানুষ আকুল হয়ে ছুটে যায় ডাক্তারবাবুর কাছে, তার প্রিয়তম লোককে রোগ থেকে বাঁচাতে। ডাক্তার তাকে চিকিত্‌সা এবং ওষুধের কথা বলেন, এই যুগ্মজগতের দর্শনের কথা বলেন না, এক প্রাসঙ্গিক পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হন। হয়তো তাঁদের বিজ্ঞানও এত একপেশে যে, বিজ্ঞান তাঁদের এই যৌথ জগতের কথা বলে না, উপযুক্ত বিদ্যায় শিক্ষিত করে না।

বহু রোগ আছে, যেখানে নিরাময় সম্ভব নয়, অসুস্থতাই মূল কথা। তাই ওষুধ দিয়ে নিরাময়ের চেষ্টা করার কথা নয়, কী ভাবে বাকি জীবন রোগী বাঁচবে, সেটা বড় কথা।

তাই আত্মীয়স্বজন এবং নিকটতম লোকজন যখন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘যেতে নাহি দিব’, তখন বহু সময় মৃত্যুদূতকেও পরাস্ত হতে হয়, বলতে হয় ‘পরে আসব’। জীবনের ইচ্ছার কাছে মৃত্যুর অমোঘতা হার মানে। মৃত্যুপথযাত্রীর মুখের হাসি, তার চোখের চকিত স্বীকৃতি আমাদের জানিয়ে দেয়, রোগী আমাদের নিয়ে বেঁচেছিল, সে সুখী হয়েছিল এবং এই সুখ নিয়ে জীবনমৃত্যুর সঙ্গে মিশে গেছে।

কোথাও সুখ, কোথাও স্বীকৃতি, কোথাও দৃঢ়তা, কোথাও বিশ্বাস, কোথাও অঙ্গীকার, আবার কোথাও মৃত্যুক্ষণ পর্যন্ত আলিঙ্গন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এ সবই জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE