Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

আরটিআই যা করতে পারে

তথ্য অধিকার আইন-এর বলে পিছিয়ে পড়া গ্রামের এক সাধারণ মহিলাও আজ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু এখনও অনেক পথ যেতে হবে।তথ্য অধিকার আইন-এর বলে পিছিয়ে পড়া গ্রামের এক সাধারণ মহিলাও আজ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু এখনও অনেক পথ যেতে হবে।

সাবির আহমেদ
শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:১৫
Share: Save:

ক লকাতা থেকে পাথরপ্রতিমা যেতে সময় লাগল সাড়ে তিন ঘণ্টা, প্রায় একশ কিলোমিটার পথ। পাথরপ্রতিমার রাসমোড় থেকে চার কিলোমিটার ভিতরে পাক্কা দেড় ঘণ্টায় পৌঁছলাম গ্রামে। গ্রামের নাম দক্ষিণ গোপালনগর। কী কী করলে মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্যর উন্নতি হতে পারে এ প্রশ্ন নিয়ে পাথরপ্রতিমার তিনটি গ্রামে প্রায় ১৫০ বেশি মহিলাদের কথা শুনলাম। প্রশ্নের তালিকা লম্বা। এ প্রশ্নের উত্তর জানলে তাঁদের জীবনের মানোন্নয়ন হত, গণতন্ত্র গণমুখী হত।

গণতন্ত্রকে প্রকৃত অংশগ্রহণমুখী করে তোলা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ জন আন্দোলনের ফলে ২০০৫ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রচলিত হয়। এ আইনের দশ বছর পালিত হচ্ছে, অথচ তথ্যহীনতার অন্যতম শিকার মেয়েরা।

বর্ষায় কবির সৃষ্টিশীল মন যখন নতুন কবিতার জন্ম দেয়, সুন্দরবনে বিভিন্ন অঞ্চলের গর্ভবতী মেয়েরা তখন আতঙ্কে ভোগেন। স্বাস্থ্যের সঙ্গে ভাল রাস্তার সম্পর্ক নিবিড়, গবেষণায় প্রমাণিত। ফলিত অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ; সরকারি হাসপাতালে প্রসব নিশ্চিত করতে অল্প ভাড়ায় ‘নিশ্চয় যান’-এর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু রাস্তা খারাপের জন্য বেশির ভাগ সময়ে ‘নিশ্চয় যান’ গর্ভবতী মেয়েদের কাছে অনিশ্চিত যান। সুতরাং প্রসববেদনা উঠলে বাঁশে বস্তা বেঁধে হাসপাতালের পথে সওয়ারি হওয়াই গতি। ঠিক সময়ে সরকারি হাসপাতালে পৌঁছতে না পেরে রাস্তায় সন্তান প্রসবের ঘটনাও কম নয়। ‘খারাপ রাস্তার কারণে প্রসববেদনা বহুগুণ বেড়ে যায়, এ যন্ত্রণার ভাগ পুরুষ নিতে পারবে?’ মহিলা দলের অনেকেরই প্রশ্ন।

সেভ দ্য চিলড্রেন ও সুন্দরবন সোশাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার–এর যৌথ উদ্যোগে এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, পাথরপ্রতিমা ব্লকের সমীক্ষাকৃত পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রায় ৬৫ শতাংশ মহিলা অ্যানিমিয়ার শিকার, আয়রন ট্যাবলেটের জোগান অনিয়মিত। মানবিক বিকাশের একটা প্রাথমিক শর্তই পুষ্টি; বিনা নোটিশে মিড মিলের খাবার দু’মাসের জন্য বন্ধ হয় কী করে? মায়েরা জানতে চান।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর— বঞ্চনার ছবিটা একই। বিপিএল পরিবার ভুক্ত মানোয়ারা বেওয়া-র স্বামী ফারুক শেখ ভিন্ন রাজ্যে দিনমজুরি করতেন। অসুস্থতা নিয়ে বাড়ি ফেরার কয়েক দিনের মধ্যে, প্রায় বিনা চিকিৎসায়, তাঁর মৃত্যু হয়। পঁয়ত্রিশ বছরে বিধবা মানোয়ারার উপর পড়ে পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালানোর ভার। স্বামীর মৃত্যুর পরই খারুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে বিধবা ভাতার আবেদন করেন। হরিনাম ব্লকের লক্ষ্মীপুর গ্রামের রেজিনা বেওয়াও স্বামী মারা যাওয়ার পরে বিধবা ভাতার আবেদন করেছিলেন। ‘কাল আসুন’ শুনতে শুনতে কেটে গেছে প্রায় পনেরো বছর, শিকে ছেঁড়েনি। ‘গরিবের নিয়তি না খেতে পেরে মরা’ এ ধারণা নিয়ে বিধবা ভাতার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র জানতে পারে তাঁদের কথা; কেন্দ্রের কর্মীর সাহায্যে প্রায় বিনামূল্যে (বিপিএল) কপাল ঠুকে তথ্য অধিকার আইন অনুসারে আবেদন করলেন মানোয়ারা ও রেজিনা বেওয়া। জানতে চাইলেন বিধবা ভাতার আবেদনপত্রের অগ্রগতি কী, কত দিনের মধ্যে বিধবা ভাতার টাকা পাবেন তাঁরা। ১৪ বছরে যা হয়নি, এক মাসে তা সম্ভব হল।

ভগবানগোলা ব্লকের পদ্মাপারের বাসিন্দা রিনা বিবি, ভাঙনে বাড়ি গেছে নদীগহ্বরে। অস্থায়ী বাসায়, বর্ষার ঝোড়ো হাওয়া ও ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে আঁচল দিয়ে ছ’মাসের ছেলের মাথা ঢাকছেন, আবার আধভেজা কাঠের উনুন আড়াল করছেন। রিনা বিবি জানেন বিপিএল পরিবার ঘর তৈরির জন্য সাহায্য পেতে পারে, আবেদনও করেছেন। নদী-ভাঙন এলাকায় রিনা বিবির মতো অনেকেরই প্রশ্ন, ইন্দিরা আবাস যোজনায় আবেদন করার কত দিন পরে তাঁদের জন্য বরাদ্দ ঘর তৈরির টাকা পাবেন?

গ্রামীণ কর্ম নিশ্চয়তা প্রকল্পের কাজ করে দীর্ঘ দিন মজুরি না পাওয়াটা নতুন কোনও খবর নয়। তবে ওঁরা চুপ করে বসে থাকেননি। শ্রীপুর মহিলা ও খাদি উন্নয়ন পরিচালিত ‘প্রত্যয়’ মহিলা গোষ্ঠীর মহিলারা তথ্য অধিকার আইন বলে জানতে চাইলেন: কাজের টাকা কবে পাবেন৷ কিছু দিনের মধ্যে মজুরি পেয়েছিলেন।

তথ্য অধিকার আইন-এর বলে পিছিয়ে পড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামেরও এক সাধারণ মহিলা আজ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু এখনও অনেক পথ যেতে হবে। পাথরপ্রতিমায় দেখা গেল, আলোচনায় উপস্থিত সত্তর শতাংশ মহিলা জানেন না তথ্য জানাও তাঁদের অধিকার। তথ্য জানা নাগরিকের অধিকার, এটা না জানানোর মধ্যে লুকিয়ে আছে শাসকের দীর্ঘ দিনের লালিত ক্ষমতা। জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন, এই আইনের পরিধি ও গভীরতা আরও অনেক বাড়ানোর সুযোগ আছে, বিশেষ করে ‘স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য উন্মোচন’-এর বিধানটি অনেক বেশি করে প্রয়োগ করা দরকার।

প্রতীচী ইন্সটিটিউট এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE