Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আহা-হা, এ যে সাক্ষাৎ দুগ্গা-ঠাকরুন গো

তারাশঙ্কর, সমরেশ, সুনীল, সত্যজিৎ। তাঁদের সৃষ্টিতে অমর হয়ে আছেন কিছু মানুষ, যাঁরা দুর্গাপ্রতিমা গড়েন। প্রতিমা আর শিল্পী, দুইয়ের পিছনেই ছায়া ফেলেন বাস্তব নানান চরিত্র। মন দিয়ে খুঁজলে সে সব ছায়াকে চিনে নেওয়া যায়।প্রতিমা শিল্পীর নাম কুমারীশ মিস্ত্রি। মিস্ত্রি তাঁর পারিবারিক পদবি, না লোকমুখে প্রচলিত খেতাব, তা খোঁজার চেষ্টা বৃথা। এই মৃৎশিল্পীকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘প্রতিমা’ গল্পে: ‘বুড়া মিস্ত্রি কুমারীশ... শীর্ণ খর্বাকৃতি মানুষ কুমারীশ, হাত-পাগুলি পুতুল-নাচের পুতুলের মতো সরু এবং তেমনি দ্রুত ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে নড়ে। আর চলেও সে তেমনি খর গতিতে।’

উপন্যাসের নায়ক শিল্পী অভয়চরণ দাস। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

উপন্যাসের নায়ক শিল্পী অভয়চরণ দাস। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

জয়ন্ত দাস
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

প্রতিমা শিল্পীর নাম কুমারীশ মিস্ত্রি। মিস্ত্রি তাঁর পারিবারিক পদবি, না লোকমুখে প্রচলিত খেতাব, তা খোঁজার চেষ্টা বৃথা। এই মৃৎশিল্পীকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘প্রতিমা’ গল্পে: ‘বুড়া মিস্ত্রি কুমারীশ... শীর্ণ খর্বাকৃতি মানুষ কুমারীশ, হাত-পাগুলি পুতুল-নাচের পুতুলের মতো সরু এবং তেমনি দ্রুত ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে নড়ে। আর চলেও সে তেমনি খর গতিতে।’

তারাশঙ্করের এই উপাখ্যান নিয়ে কুমোরটুলির প্রবীণ শিল্পীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি অনেক দিন ধরে। স্বাধীনতার দশ বছর আগে গল্পটি প্রকাশিত হয় এই পত্রিকারই শারদীয় সংখ্যায়। সে সময় কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পী ধনঞ্জয় রুদ্রপাল ছিলেন ফরিদপুরে। এখন প্রয়াত এই মানুষটি একদা গল্প করেছিলেন, শ্রাবণের শেষ দিকে বাবা কাকা জ্যাঠাদের সঙ্গে বিক্রমপুরের গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা বানানোর কাজ করতেন। সবই বাঁধা-বাড়ির কাজ। ‘প্রতিমা’ গল্পের চাকলা গ্রামে কুমারীশের আসার মতোই! ‘চাটুজ্জে-বাড়ি’র প্রতিমা নির্মাণে মগ্ন কুমারীশকে এক রাত্রে ভাইপো যোগেশ যখন বলেছিল: ‘কাকা, রাত অনেক হল, আজ আর থাকুক।’ সে কথা শুনে কুমারীশ উত্তেজিত: ‘থাকুক! কালও এক বেলা এইখানে কাটুক, না কি? প্রতিমা যে সাতাশখান, তা মনে আছে?’ ফরিদপুরের ধনঞ্জয় আর চাকলার কুমারীশদের মধ্যে প্রতিমা গড়ার কাজে মিল অনেক, কারণ বাঁধা বাড়ির কাজ এপার ওপার দু’পারেরই সাবেক প্রথা। কুমারীশের সাতাশখানা মূর্তি গড়ার কথা শুনে ধনঞ্জয় দাবি করতেই পারেন তাঁদের বাবা-কাকার দল বিক্রমপুরে আটচল্লিশটি বাড়ির প্রতিমা গড়তেন। বা আরও বেশি।

কিন্তু কুমারীশ বাংলা ছোটগল্পে ‘চরিত্র’ হয়ে উঠলেন অন্য কারণে। প্রতিমা গড়তে চাটুজ্জে-বাড়িতে এসে তাঁর দৃষ্টি পড়ে ছোট বউ যমুনার দিকে: ‘আহা-হা, এ যে সাক্ষাৎ দুগ্গা-ঠাকরুন গো, অ্যাঁ, এমন চেহারা তো আমি দেখি নাই! আহা-হা! অ্যাঁ, এমন লক্ষ্মী ঘরে থাকতে...!’ মাটির প্রতিমা গড়ে তুলতে তুলতে যমুনার সঙ্গে পরমাত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে কুমারীশের। প্রতিমা তৈরি শেষ হয়। দর্শনার্থীদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, প্রতিমার মুখখানিতে যমুনা বসানো! তার পর, সাক্ষাৎ ‘দুগ্গা-ঠাকরুনের’ মৃতদেহ বিজয়া দশমীর সকালে ভেসে উঠল খিড়কির ঘাটে। একদা যামিনী রায় তারাশঙ্করকে বলেছিলেন: ‘ভায়া, বিয়োগান্তক রচনা আর করবেন না...।’ কিন্তু স্রষ্টা নিরুপায়।

গোরাচাঁদ পালের ছেলে গোপাল পাল, বিক্রমপুরের জিতেন পাল, ফরিদপুরের অনাদি পাল, কেউই তারাশঙ্করের কাহিনির পরিণতি মেনে নিতে পারেননি। দুর্গাপ্রতিমার মুখে ছোট বউমার মুখের আদল এলে বউমা আত্মহত্যা করবেন কেন? ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহে তো তাঁরা দেখেছেন অন্য ছবি। শ্রীকৃষ্ণ পাল বললেন: ‘ঢাকার অনেক সম্ভ্রান্ত বাড়িতেই রেওয়াজ ছিল, পরিবারে সুন্দরী বউ আনা হলে মূর্তিশিল্পীর কাছে বায়না হত বউমার মতো

প্রতিমা গড়ে দিতে হবে। বাড়ির সদ্য বিয়ে হওয়া বড় মেয়ে মেজ মেয়ের মুখও তুলে ধরতে হত প্রতিমায়। এ বিষয়ে দক্ষ শিল্পীদের আনা হত ফরিদপুরের পালঙ, বরিশালের ঝালোকাটি বা বিক্রমপুরের কাঁচাদিয়া থেকে।’ কেদার মজুমদারের ‘ঢাকার বিবরণ’ গ্রন্থে দেখছি কাঁচাদিয়ার শিল্পী শম্ভুচন্দ্র সেন ‘উচ্চশ্রেণির মৃন্ময় মূর্তি প্রস্তুত করিতে পারিতেন।’

ঢাকার শিল্পী রাখালচন্দ্র পালের কাছে শুনেছি আর এক কাহন। ‘দ্যাশ গাঁয়ে ওই বড় বউ বা নতুন বউ-গো মুখ গড়াইলে তারে কইতো ছবি-আয়না মুখ। আমাগো পর-পুরুষের সামনে তো বউরা মুখ দেখাইত না! তো সেই মুখ বানাই ক্যামনে? বিধান হইল, হয় বউমার ছবি দেইখ্যা কিংবা ছবি না পাইলে বউ আয়নার সামনে খাড়াইব আর কুমার দূর থিক্যা সেই আয়না দেইখ্যা মুখ গড়ব। তয় হইব ছবি-আয়না মুখ।’ মুখ দেখার আর একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন মৃৎশিল্পীরা। কষ্টিপাথরের পাত্রে জল রেখে, জলের আয়নায় বউমার মুখ দেখে মূর্তি গড়তেন তাঁরা। কুমোরটুলির কৃষ্ণনগরের শিল্পী নিরঞ্জন পাল অবশ্য উত্তমকুমারের বাড়ির লক্ষ্মীপ্রতিমার মুখে গৌরী দেবীর মুখ বসিয়েছিলেন তাঁকে চাক্ষুষ দেখেই। আয়না, ছবি, জলভরা পাথরবাটির দরকার পড়েনি।

একুশ বছর বয়সে সমরেশ বসু লিখেছিলেন ‘নয়নপুরের মাটি’। তাঁর প্রথম উপন্যাস। চাষির ঘরের ছেলে মহিমের চাষ-আবাদে মন নেই। রাইফেল ফ্যাক্টরির অফিসে বসে সমরেশ বসু চরিত্রটি আঁকছেন: ‘দুর্গা পুজো এগিয়ে আসছে। কুমোরেরা মূর্তি গড়ছে মাটির, সমস্ত দেবদেবীদের। স্কুল পালিয়ে মহিম তখন শুধু কুমোরবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করছে।... নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, নেই লেখাপড়া, একমাত্র কাজ মাটির পুতুল বানাবার কারিগরি দেখা। প্রয়োজন মতো ব্যস্ত কারিগরদের ফাই-ফরমাস খাটা থেকে শুরু করে ইস্তক তামাক ভরে দেওয়া পর্যন্ত। কিছুই বাদ যায়নি। প্রতিদানে শুধু তাকে ভাগিয়ে না দিয়ে চুপচাপ করে বসে সেই মূর্তি গড়া দেখতে দেওয়া।... অর্জুন পাল ভালবেসেছিল মহিমকে। বুঝেছিল, ছেলেটার চোখে যেন থেকে থেকে স্বয়ং বিশ্বকর্মা ভর করে...।’

সমরেশ বসু মহিমকে দিয়ে হাতখানেক লম্বা দশভুজার মূর্তি গড়ালেন। গ্রামসুদ্ধ লোককে দিয়ে ধন্য ধন্য করালেন: ‘ও মা! এ যে সত্যি সত্যি দুগ্গা পিতিমের মতোই হয়েছে গো।’ বছর কয়েক প্রতিমা বানানোর তালিম দিয়ে তাকে বামুনপাড়ার পাশ করা শিল্পী গৌরাঙ্গসুন্দরের সঙ্গে নয়নপুর থেকে টেনে আনলেন কলকাতায়। দেখালেন রাজধানীর মিউজিয়ম, চিত্রশালা, আর্ট স্কুল। কৃষ্ণনগরও। ‘বাবার থানের মতো লুকিয়ে সে প্রণাম করেছে কৃষ্ণনগরের মাটিকে।’ মহিমের শিল্পচর্চা শুরু হল গৌরাঙ্গের মেসে।

কাকতালীয়? ফরিদপুরের পালঙ থেকে কলকাতায় শিল্পের পাঠ নিতে এলেন রমেশচন্দ্র পাল ১৯৪১-এ, পরে যিনি ভাস্কর রমেশ পাল হন, আর তিন বছরের মাথায় সমরেশ বসুর উপন্যাসে মহিম মণ্ডল ওপারের মধুমতী নদীর কোল ঘেঁষা এক গ্রাম নয়নপুর থেকে কলকাতায় আসেন গৌরাঙ্গসুন্দরের সঙ্গে। উদ্দেশ্য একই, শিল্পের পাঠ। রমেশচন্দ্র শেষ পর্যন্ত কলকাতার বাসিন্দা হয়ে যান, মহিম তিন বছর পরে ফিরে যায় ছায়াসুনিবিড় নয়নপুরে। রমেশচন্দ্র দাবি করতেন, তিনি প্রতিমার ব্যবসা করতে এখানে আসেননি, সর্বজনীন কর্তাদের চাপে তাঁকে প্রতিমা গড়তে হত। নয়নপুরের মহিম কিন্তু জমিদারবাড়ির প্রতিমা গড়ার বায়না ফিরিয়ে দেয়। এস্টেটের মাইনে করা শিল্পীর চাকরিও।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রতিমা’ গল্প অনুসরণে তৈরি ঋতুপর্ণ ঘোষের

‘অন্তরমহল’ চলচ্চিত্রে অভিষেক বচ্চন। ছবি সৌজন্য: দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

তবে কি গোপেশ্বর পালকে খুঁজে দেখব মহিমের মধ্যে? কৃষ্ণনগরের যে মাটিতে বাবার থানের মতো মাথা ঠেকিয়েছিল মহিম, গোপেশ্বর সেখানকার ভূমিপুত্র। সে বার লর্ড কারমাইকেল দেখতে এসেছেন ঘূর্ণির মৃৎশিল্প। যদুনাথ পালের চালাঘরে বসে পুতুল গড়ছিলেন গোপেশ্বর। সাহেবকে দেখে মাটির তালে দ্রুত হাত বুলিয়ে গড়ে ফেলেন কারমাইকেলের মাথা। সাহেব থ! এই ঘটনাই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় লন্ডনের ওয়েম্বলি পার্কে, ব্রিটিশ এম্পায়ার একজিবিশনে। গোপেশ্বর পাল চমকে দেন রানি ভিক্টোরিয়ার সেজ ছেলে ডিউক অব কনট-এর আবক্ষ মূর্তি গড়ে। ডিউকের কন্যা গোপেশ্বরের তৈরি সব মূর্তি কিনে নেন। এর পরে গোপেশ্বর আর বেশি দিন দুর্গাপ্রতিমা গড়েননি। বহু দেশ ঘুরে শিল্পচর্চার নানা তালিম নিয়েছেন। কুমোরটুলির এক প্রান্তে প্রকাণ্ড স্টুডিয়ো গড়েছেন। বাংলার খ্যাতনামাদের মূর্তি খোদাই করেছেন।

১৯৪২। ডিসেম্বর মাস। ‘রাতের অন্ধকারে কয়েকখানা জাপ বোমারু বিমান উড়ে এসে দুটো মাঝারি সাইজের বোমা ফেলে চলে গেল।... বোমা দুটো পড়ল হাতিবাগান বাজারে এবং দর্জিপাড়ার ভড় লেনের একটি বাড়িতে...।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসে এই বোমা পড়ার ঘটনার পরই কাহিনির কিশোর নায়ক বাদল সপরিবার পাড়ি দেয় মামাবাড়ি পূর্ববঙ্গে। বাদলের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনেকটাই নাকি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাই বোঝাই যায়, ওই মামাবাড়ি আসলে তাঁর মায়ের মামাবাড়ি ফরিদপুরের আমগ্রাম।

আমগ্রামে ‘...মামাবাড়ির মূর্তি বানাত জলধর। হঠাৎ একদিন তার নৌকো এসে ভিড়ত পুকুরঘাটে। বড় রহস্যময় ছিল তার নৌকাটি। ভেতরে কত রকম তুলি আর রঙের পাত্র আর মুখের ছাঁচ। রুপোলি জরির কলকা আর রেশমি কাপড়ও থাকত প্রচুর। মাঝখানে একটা পরদা ফেলা— সে পরদার ওপাশে কী থাকত কে জানে।’

জলধরের পুরো নাম কি জলধরচন্দ্র রুদ্রপাল? লেখক জানাননি। তবে নিচু জাত বলে তাকে সবাই তুমি-তুমি বলত— এটুকু জানা যাচ্ছে। আর জানতে পারছি, ‘জলধর লোকটি বেশ বেঁটেখাটো এবং গম্ভীর। তাকে আমরা কথা বলতে শুনেছি খুব কম। সে যে একজন শিল্পী ছিল, তার গাম্ভীর্যই তার প্রমাণ।’ খেয়াল করছি, জলধর নামটি ‘অর্ধেক জীবন’-এও স্বমহিমায়।

ঢাকা-বিক্রমপুরের ষোলোঘর গ্রামের মৃৎশিল্পী রাখালচন্দ্র পালের সঙ্গে বেশ মিল আছে জলধরের চেহারা ও চরিত্রের। রাখালচন্দ্র কুমোরটুলিতে আসেন ১৯৪৮-এ। সঙ্গে চার ভাই: হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল আর মোহনবাঁশি। গোড়ার দিকে প্রতিমার মুখ গড়তে তিনি ছাঁচ ব্যবহার করতেন না। বলতেন, ‘ধ্যান কইর্যা মুখ বানাইতাম!’ ধ্যান বস্তুটি কী, কখনওই বুঝিয়ে বলতেন না। খানিক চুপ করে থেকে বলতেন, ‘শ্রীমুখের তপস্যা!’

জলধরও দেখছি তেমনই: ‘লক্ষ্মী সরস্বতী আর কার্তিকের মুখ সে ছাঁচে ঢেলে বানায়। গণেশের মুণ্ড তো হাতে বানাতে হবেই। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে দুর্গার মুখ— তার জন্য সে কোনও দিন ছাঁচ ব্যবহার করেনি। একতাল মাটি সে অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে ছানাছানি করে, এদিক-ওদিক ঘোরে, নানা কথা ভাবে। তারপর হঠাৎ এক সময় বিদ্যুৎবেগে সে মুখখানি বানিয়ে ফেলে। দেড়-দু’মিনিটের বেশি লাগে না। তখন সেই মুখটা প্রতিমার ওপর বসিয়ে সে অনেক দূরে চলে যায়, চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এক একবার ছুটে এসে নাকের পাশটা একটু টিপে দিয়ে যায়, চোখটা একটু বড় করে। পরদিন সে রং তুলি নিয়ে বসে।’

এ হেন গ্রাম্য সাদাসিধে এক মৃৎশিল্পীকে দিয়ে ঢাকা থেকে সদ্য ডাক্তারি পাশ করে আসা বাদলের অতীনমামা এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন। পুজোর ঠিক দু’দিন আগে শিল্পীকে একটি ছবি দেখিয়ে চুপি চুপি বললেন, ছবি দেখে অমন মূর্তি গড়তে পারবে কি না। এর পরই গোটা ঠাকুরদালান কাপড় দিয়ে ঘিরে ফেলা হল। কাউকেই দেখতে দেওয়া হবে না শেষ মুহূর্তের মূর্তি নির্মাণ।

‘ষষ্ঠীপুজোর দিন যখন পরদা উঠল, ঠাকুরের মূর্তি দেখে আমরা সবাই অবাক। অনেক কিছুই বদলে গেছে।... সরস্বতী হংসবাহিনী—তাঁর রং দুধে আলতা, লক্ষ্মীর রং কাঁচা হলুদ, লাল রঙের পেট মোটা গণেশ, দুর্গার মুখও জলধরের নিজস্ব— কিন্তু কার্তিক নেই— সেখানে সুভাষ বসু দাঁড়িয়ে। সুভাষ বসুর মূর্তির গায়ে পুরোপুরি সামরিক পোশাক— দেবসেনাপতির যোগ্য তাঁর বীরত্বব্যঞ্জক ললাট ও চক্ষু, শুধু গোল চশমাটা একটু কেমন কেমন দেখায়। আর নীল-রঙা অসুরের বদলে সেখানে রয়েছে একজন ইংরেজ মিলিটারি...।’ ব্রিটিশ শাসিত ভূখণ্ডের এক অজপাড়াগাঁয়ে অখ্যাত মৃৎশিল্পী বিপ্লবটি ঘটালেন। ১৯৪৩-এর কুমোরটুলি কিন্তু তখনও মান্ধাতা আমলের ‘কংসনারায়ণী’ বা ‘বিষ্ণুপুরী’ ঘরানার প্রতিমা নির্মাণে মগ্ন। মৃৎশিল্পী অলক সেন কয়েক দশক পরে সামাজিক অনাচার, রাজনৈতিক হত্যা বা শাসকের ষড়যন্ত্র নিয়ে প্রতীকী অসুর গড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

এ বার বারাণসী। দশাশ্বমেধ ঘাটের উত্তরে দুর্গাকুণ্ড রোডের উপর ‘শংকরী নিবাস’। কেউ বলেন ঘোষালবাড়ি। আদতে ‘ইস্টবেঙ্গলের জমিদার পরিবার’। চতুর্থীর দিন এ বাড়ির মৃৎশিল্পী শশীভূষণ পালের সঙ্গে ফেলুদার আলাপ শোনা যাক। ‘...শশীবাবু নারকোলের মালায় হল্দে রং নিয়ে নিজের তৈরি তুলি দিয়ে কার্তিক ঠাকুরের গায়ে লাগাচ্ছিলেন। ভদ্রলোকের বয়স ষাট পঁয়ষট্টি হবে নিশ্চয়ই, রোগা প্যাঁকাটি চেহারা, চোখে পুরু কাচের চশমা। ফেলুদা জিজ্ঞেস করাতে বললেন উনি নাকি ষোলো বছর বয়স থেকে এই কাজ করছেন। ওঁর আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগর, ঠাকুরদাদা অধর পাল নাকি প্রথম কাশীতে এসে বসবাস আরম্ভ করেন সিপাহি বিদ্রোহের দু’বছর পরে। শশীবাবু থাকেন গণেশ মহল্লায়। সেখানে নাকি ওঁরা ছাড়াও আরও কয়েক ঘর কুমোর থাকে...।’ শশীবাবুর কাজের নিষ্ঠা সত্যজিৎ রায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ উপাখ্যানে। মূর্তি নির্মাণ শেষ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে গণেশ মহল্লার অন্ধকার গলিতে নির্মম ভাবে নিহত হন বৃদ্ধ শশীবাবু। তাঁর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

বাস্তবেও প্রতিনিয়ত মৃৎশিল্পীরা রক্তাক্ত। সে কাহিনি লিখেছেন অনিতা অগ্নিহোত্রী, ‘অকালবোধন’ উপাখ্যানে। রূপেন দাস তথা রূপীন চামারের ছেলে অর্জুনের মৃৎশিল্পী হওয়ার কাহিনি। ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘...একে তো মৃৎশিল্পী মরণের সঙ্গে লড়াই করছে, ক্রমবর্ধমান মজুরি ও কাঁচামালের দাম, নিয়ন্ত্রণহীন বাজার, আকণ্ঠ ঋণে জর্জর শিল্পীরা— তারই মধ্যে অন্য পাড়া, অন্য জাত অর্জুনের। তার লড়াই-এর চেহারা আরও কঠিন।’

ময়মনসিংহের শিল্পী রাম পালের কাছে অর্জুনের নাড়া বাঁধার গল্প অনেকটা নয়নপুরের মহিমের মতোই। তবে কুমোরটুলির চালচিত্রে যেহেতু এই উপাখ্যান, তাই গত শতকের খ্যাতিমান শিল্পী গোরাচাঁদ পালের চক্ষুদানের কীর্তি, রাম পালের প্রতিমা সাজানো, হৃদয়বল্লভের মুখ গড়া, বা গঙ্গার ঘাটে রমেশ পালের মাটির প্রতি মমত্ববোধ জেগে ওঠা ফুটিয়ে তুলতে তুলতে এগিয়ে চলে কাহিনি। ‘অকালবোধন’-এর অর্জুন দাস যে আসলে পূর্ব কলকাতার এন্টালি অঞ্চলের মৃৎশিল্পী অভয়চরণ দাস, তা লহমায় বুঝিয়ে দেয় অনিতা অগ্নিহোত্রীর সমীক্ষাভিত্তিক গ্রন্থ ‘কলকাতার প্রতিমাশিল্পীরা’।

‘অকালবোধন’-এর অর্জুন দাসের গল্প আর শুভাশিস দত্তের ‘ঘূর্ণি’ উপন্যাসে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী বিরাই পালের ছেলে সুবীর পালের গল্প জীবনযুদ্ধে ভরা। নিজেদের হাতের রং করা প্রতিমার মতো রং মাখানো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে গিয়েও হারায় না ওরা। মাটি তাদের বারে বারে ফিরিয়ে আনে। অর্জুন দাস যেমন প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করে মৃত্তিকার ঘ্রাণ, মৃদু তাপ, শ্বাসপ্রশ্বাস, সুবীর পালও নারী শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাষা বোঝে, টের পায় তার মাংসল স্পন্দন। শেষ পর্যন্ত সেই স্তব্ধ মানবী যেন উভয়কেই অভয় দান করেন— আমি আছি, আমি আছি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta das editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE