কখনও তিনি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাইতেছেন, কখনও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দুষিতেছেন। কখনও আবার ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে’ বুঝিয়া লইবার হুমকি দিতেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক কী বলিতে চাহেন, সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন না। হয়তো তাঁহার অভিমান হইয়াছে। গোটা দেশ তাঁহার রাজ্যকে যে ভাবে একটি ‘ব্যর্থ রাজ্য’ হিসাবে দেখিতেছে, তাহাতে মুখ্যমন্ত্রীর অহঙ্কার আহত হইয়াছে। তাঁহার পুলিশ তাঁহার কথা শুনিতেছে না, অর্থাৎ ভোটের দিন তৃণমূলের বাহুবলীদের যথেচ্ছাচার করিতে বাধা দিতেছে— ইহাই যদি অভিমানের একমাত্র কারণ হয়, তবে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নাই। কিন্তু, তিনি যদি ভাবেন যে রাজধর্ম পালনে গোটা দেশ তাঁহাকে যতখানি ব্যর্থ জ্ঞান করিতেছে, তাঁহার প্রকৃত ব্যর্থতা তাহার তুলনায় কম, তবে তাঁহার কর্তব্যের কথাটি তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় বাহিনী চলিয়া গেলে ফের তাঁহার অধীনেই থাকিতে হইবে, তিনি হুমকি দিয়া রাখিয়াছেন। ১৯ তারিখের পর কী হইবে, তাহা বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র জানে। কিন্তু, এখনও তিনিই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি যদি প্রতিশোধের হুমকি দেন, তবে পশ্চিমবঙ্গের ‘ব্যর্থ রাজ্য’ হইতে বাকি কী থাকে? প্রশাসক হিসাবে নিজের ব্যর্থতাকে অ-প্রমাণ করিতে হইলে তাঁহার একমাত্র কর্তব্য ছিল, রাজ্যে যাহাতে একটিও হিংসাত্মক ঘটনা না ঘটে, তাহা নিশ্চিত করা।
শুধুমাত্র ১৯ মে-র পরে নহে। জনগণের রায়ে যদি তাঁহার জন্য নবান্নের দরজাটি বন্ধ হইয়া যায়, তবুও ইতিহাসের পাতায় নিজের সদিচ্ছা প্রমাণ করিবার একটি সুযোগ তাঁহার আছে। দফায় দফায় নির্বাচন মিটিতেছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী পরের দফার কেন্দ্রে চলিয়া যাইতেছে। আজই শেষ পর্বের নির্বাচন। তাহার পরও রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি থাকিবে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভারটি ন্যস্ত হইবে মূলত রাজ্য পুলিশের উপর। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও ‘স্বরাষ্ট্র’মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বাহিনীর শীর্ষে। রাজ্য জুড়িয়া নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের যে ভয়াবহতা দেখা যাইতেছে, তাহাকে কঠোর হাতে দমন করিয়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসক হিসাবে তাঁহার সদিচ্ছার শেষ এবং একমাত্র নজিরটি তৈরি করিতে পারিতেন। অন্য কাহারও জন্য না হইলেও তাঁহার নিজের জন্য, তাঁহার আহত অভিমানের জন্য। কিন্তু, বাঘাযতীন হইতে দারিরচক, আরামবাগ হইতে বাসন্তী, রাজ্যের প্রতিটি প্রান্ত সমস্বরে বলিতেছে, মুখ্যমন্ত্রী পারিলেন না। তিনি প্রতিশোধের ক্ষুদ্রতা হইতে প্রশাসনের সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হইলেন না। শেষ সুযোগেও নহে।
মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য পুলিশকে ‘ভিতু’ বলিয়া তিরস্কার করিয়াছিলেন। পুলিশবাহিনী সেই তিরস্কারের মর্যাদারক্ষায় ব্যস্ত। অনুমান করা চলে, নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জোড়া ঠেলায় ভোটের দিন যে তাহারা শাসক দলের পার্শ্বে দাঁড়াইতে পারে নাই, ভোট মিটিতেই পুলিশ সুদে-আসলে সেই ক্ষতি পুষাইয়া দিতে উদ্গ্রীব। কিন্তু, সেই দায়ও বঙ্গেশ্বরীর। ‘তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী’ হইতে পাঁচ বৎসরেও তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হইয়া উঠিতে পারিলেন না। রাজনৈতিক হিংসা যখন নারীর লাঞ্ছনাকে অতিক্রম করিয়া শিশুনিগ্রহে পৌঁছাইয়াছে, তিনি তখনও নীরব। দলীয় দুষ্কৃতীরা বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে ডাকাতের ভঙ্গিতে হামলা চালাইতেছে দেখিয়াও বঙ্গেশ্বরী নিরুত্তাপ। তিনিই প্রমাণ করিতেছেন, তাঁহার রাজ্যে শুধু দল আছে, প্রশাসন নাই। এই রাজ্যটি যে সত্যই ‘ব্যর্থ রাজ্য’, তাহা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝাইয়া দিতেছেন। গোটা দেশ সেই কথা বলিলে অভিমান করা তাঁহাকে সাজে না। তিনি তো প্রশাসক হইতে চাহেন নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy