তখন জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রিত্বের মধ্যগগনে। এক সাংবাদিক তাঁহার নিকট জানিতে চাহিয়াছিলেন, ইতিহাস তাঁহাকে কোন রূপে স্মরণে রাখিবে বলিয়া তাঁহার বাসনা? উত্তরে জ্যোতিবাবু বলিয়াছিলেন, ‘ইতিহাস কি আদৌ কাহাকে স্মরণে রাখে?’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দৃশ্যত, নিজের স্মরণীয়তার দায়িত্বটি ইতিহাসের হাতে সঁপিতে ভরসা করেন নাই। রাজ্য সরকার অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে সিঙ্গুর আন্দোলনের ইতিবৃত্ত ঢুকাইয়াছে। সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলন ইতিহাস কি না, সেই তর্কে ঢুকিবার পূর্বে শিষ্টতার প্রথম পাঠটি ঝালাইয়া লওয়া ভাল। সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলনই তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনিয়াছে। সেই ক্ষমতায় থাকাকালীন, সেই ক্ষমতা ব্যবহার করিয়াই, সিঙ্গুরকে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে ঢুকাইয়া ফেলিলে তাহার অশিষ্টতা বড় বেশি প্রকট হইয়া উঠে। সিঙ্গুরের আন্দোলন যদি সত্যই স্কুলপাঠ্য ইতিহাস হইবার যোগ্য হয়, তবুও পাঠ্যক্রমে তাহার অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তটি অন্য কাহারও হওয়া বিধেয় ছিল। এমন কাহারও, যাঁহারা এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ লাভের অংশী নহেন। কয়েক বৎসর ধৈর্য করিলে ক্ষতি হইত না।
বৃহত্তর প্রশ্ন হইল, সিঙ্গুরের আন্দোলন কি আদৌ ‘ইতিহাস’ হিসাবে বিবেচিত হইবার যোগ্য? কোনও ঘটনা তখনই ইতিহাস হইয়া উঠে, যখন তাহা ঘটনাপ্রবাহে কোনও একটি বিশেষ ডিপারচার তৈরি করে, যখন সেই ঘটনা হইতে কোনও একটি নূতন ধারার সূচনা হয়। সব ঘটনা ‘ইতিহাস’-এর মর্যাদা দাবি করিতে পারে না। শিক্ষামন্ত্রী জানাইয়াছেন, শুধু সিঙ্গুরই নহে, তেভাগা আন্দোলনও পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত হইতেছে, অর্থাৎ এই অন্তর্ভুক্তির মধ্যে যে কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি নাই, তিনি তাহা গাহিয়া রাখিলেন। বাংলার কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তেভাগা যে অর্থে ইতিহাস, সিঙ্গুর যে তাহা নহে, এই কথাটি বুঝিতে প্রবল মেধার প্রয়োজন পড়ে না। সিঙ্গুরে যাহা হইয়াছে, তাহা শুধু এইটুকু: বহু ইচ্ছুক জমি মালিকের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করিয়া কতিপয়ের অনিচ্ছাকে রাজনীতিতে জারাইয়া জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া বানচাল করা হইয়াছে। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক যাত্রাপথে এই ঘটনার গুরুত্ব অসামান্য, কিন্তু রাজ্যের বা দেশের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এই আন্দোলন কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ, তাহা বিচার করিবার সময় এখনও হয় নাই। ফলে, পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজের রায় জানাইয়া দিলেও, সিঙ্গুরের আন্দোলন আদৌ কখনও ‘ইতিহাস’ হইতে পারিবে কি না, তাহা অমীমাংসিত।
শুধু স্কুলের পাঠ্যক্রমেই নহে, উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোনও ঘটনাকে ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়ার পূর্বে নির্দিষ্ট সময়কাল অপেক্ষা করাই বিধেয়। নচেৎ, তাহার মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনার ভাগ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হইয়া যায়। এমনকী, দলীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও এই কথাটি সমান সত্য। ইতিহাস যদি মতসাপেক্ষ হয়, তবে তাহা দীননাথ বাত্রা-র স্তরে নামিয়া আসে। আন্দোলন হিসাবে সিঙ্গুর কখনও ইতিহাসের ধারার অন্তর্গত হইবে কি না, সেই প্রশ্ন ভিন্ন— কিন্তু শুধুমাত্র সিঙ্গুরের ইতিহাস যখন রচিত হইবে, তখনও যদি তাহা প্রকৃত অর্থেই তথ্যনিষ্ঠ, বস্তুনিরপেক্ষ ইতিহাস হয়, তবে তাহার সবটুকু তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির প্রতি ইতিবাচক হইবে না। তৃণমূলের নজরদারিতে সেই ইতিহাস রচিত হইলে, অতএব, তাহার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া অসম্ভব। পার্থ চট্টোপাধ্যায় যাহাই দাবি করুন, ইতিহাস আর ইস্তেহারে ফারাক অনপনেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy