Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ইংরেজি তো এখন একটি ভারতীয় ভাষায় পরিণত

ভারতে চিরকালই একাধিক ভাষার চর্চা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। ইংরেজি শেখার সঙ্গে কি তার কোনও বিরোধ আছে? হিন্দি চাপিয়ে দিলেই কি সেই সব ভাষার উপকার হবে? লিখছেন নীতি নায়ারসম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সার্কুলার নিয়ে খুব শোরগোল হয়েছে। সার্কুলারটিতে সোশাল মিডিয়ায় হিন্দি ভাষার ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে শত শত ‘আর্বান অফিশিয়াল ল্যাংগোয়েজ অপারেশনাল কমিটি’র মাধ্যমেও হিন্দির প্রসারে উৎসাহ দেওয়ার কথা আছে।

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সার্কুলার নিয়ে খুব শোরগোল হয়েছে। সার্কুলারটিতে সোশাল মিডিয়ায় হিন্দি ভাষার ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে শত শত ‘আর্বান অফিশিয়াল ল্যাংগোয়েজ অপারেশনাল কমিটি’র মাধ্যমেও হিন্দির প্রসারে উৎসাহ দেওয়ার কথা আছে। এই খবরটি দেখে মনে পড়ল, অতীতেও বিভিন্ন সময়ে এ দেশে এমন কিছু উদ্যোগ হয়েছে এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেওয়া হয়নি। স্বাধীন ভারতের প্রথম পর্ব থেকে রাজনীতিক এবং আধিকারিকরা শিক্ষার পরিসরেই হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার মান ঠিক রাখা ও প্রত্যাশা পূরণ করা আজও খুব বড় চ্যালেঞ্জ।

দেশ জুড়ে স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম কী হবে, রাধাকৃষ্ণন কমিশনের রিপোর্টে (১৯৪৯) সেই প্রশ্ন বিচার করা হয়েছিল। সেখানে ‘ফেডারাল’ বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দির পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার প্রসারের সুপারিশ করা হয়েছিল, তার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির কথাও ছিল। এই প্রসঙ্গে কমিটি ‘যুগধর্ম’-এর কথা বলেছিল: ‘গোটা দুনিয়ার একত্বের একটা বোধ গড়ে উঠছে, এবং দেশের অন্য যে কোনও ভাষার তুলনায় বেশি প্রচারিত একটি ভাষার উপর দখল থাকলে আমাদের প্রভূত লাভ হবে।’

কথা ছিল, এর পরের পনেরো বছর বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় পাঠ্যবই এবং অন্যান্য গ্রন্থ তৈরি হবে, বিজ্ঞানের পরিভাষা তৈরি হবে, উচ্চ শিক্ষার পঠনপাঠনে সেই সব ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করা হবে। কিন্তু কার্যত কী হল? দিল্লির শাসকরা যত দ্রুত সম্ভব হিন্দি চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিভিন্ন ভাবে সেই চেষ্টা করলেন তাঁরা। হায়দরাবাদ রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরেই সেখানকার ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আদর্শ হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার নীতি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু উর্দু মাধ্যমের এই বিশ্ববিদ্যালয় সেই নীতি মানতে নারাজ হয়। সুদূর দিল্লি থেকে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে স্থানীয় কংগ্রেস নেতারাও অচিরে শামিল হন, দলীয় হুইপ না মেনে বিবেকের অনুশাসন মাফিক ভোটদানের অধিকার দাবি করেন তাঁরা। পাঁচ বছর ধরে আন্দোলন চলার পরে প্রধানমন্ত্রী নেহরু স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, ‘অন্ধ্রের সরকার এবং জনসাধারণের উপর জোর করে একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে কোনও লাভ নেই।’

স্কুলশিক্ষাতেও ‘জাতীয় সংহতি’র নামে একটা অভিন্নতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯৫০ সালে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি আবেদন পেশ করা হয়। সংবিধানের ২৯ ও ৩০ ধারায় সংখ্যালঘুর অধিকার সম্পর্কে যে নির্দেশ আছে, তার ভিত্তিতে তাঁরা অনুরোধ জানিয়েছিলেন, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে তাঁদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিকে স্কুল বোর্ডের অনুমোদন দেওয়া হোক, বোর্ডের নিয়মকানুন সংশোধন করে নেওয়া হোক।

এই আবেদনের উত্তরে পি গঙ্গোপাধ্যায় নামে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের এক আধিকারিক জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার মনে হয়, এখানে একটা সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। জাতীয় স্তরে হিন্দিকে সরকারি ভাষা করে তুলতে হবে এবং রাজ্য স্তরে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই অনিবার্য প্রক্রিয়াটিকে স্বীকার করা হয়নি। এর ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি।... এটা সকলেই জানে যে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির ভূমিকা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে... হিন্দি অথবা স্থানীয় ভাষার গুরুত্ব উত্তরোত্তর বাড়ছে। মোটামুটি এক দশকের মধ্যে ইংরেজি কার্যত ‘মৃত’ ভাষায় পরিণত হবে।” এই অভিমতকে তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা ভাবলে ভুল হবে, শিক্ষা মন্ত্রকের অন্য আধিকারিকরাও সাধারণ ভাবে একই মত পোষণ করতেন।

তবে ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের আগে পর্যন্ত শিক্ষা সংবিধানের ‘রাজ্য তালিকা’র অন্তর্ভুক্ত ছিল, ফলে রাজ্য স্তরের স্কুল শিক্ষা বোর্ড এবং বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা স্বাধীনতা ছিল, কেন্দ্রীয় শিক্ষা বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অথবা নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে যে সব সুপারিশ পাঠানো হত, তারা সেগুলি নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে নিতে পারত। কিন্তু এই কথাটা বলা দরকার যে, ভাষার রাজনীতিতে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সংঘাত কেবল ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনে কিংবা সরকারি ভাষা সংক্রান্ত আইনের বিভিন্ন সংশোধনের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে সব সংশোধন এবং সংস্কার চলছে তা দেখিয়ে দেয় যে, এখনও খুব বড় চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে।

প্রায় একশো বছর আগে পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা যা বলেছিলেন, মনে করা যেতে পারে। ১৯১৮ সালে তিনি স্যাডলার কমিশনকে বলেন, ইংরেজি হল ‘বিদেশি ভাষা’। তিনি এই ভাষা বোঝা এবং তা নির্ভুল ভাবে লিখতে পারার মধ্যে একটা পার্থক্য করেছিলেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, ইংরেজিকে দখলে আনতে হলে ‘সময়, চর্চা এবং দীর্ঘ অনুশীলন’ দরকার। কিন্তু তাঁর মতে ইংরেজির একটা ‘পর্যাপ্ত’ জ্ঞান অর্জন করা হল ‘জাতীয় প্রয়োজন’ এবং ‘দৈনন্দিন গুরুত্ব’-এর ব্যাপার এবং সেই কারণে তাঁর সুপারিশ ছিল, ‘ইংরেজি নির্ভুল ভাবে লেখা নয়, এই ভাষা বুঝতে পারা এবং ইংরেজি বই স্বচ্ছন্দ ভাবে পড়তে পারার দক্ষতা অর্জন’ প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পক্ষে জরুরি, এটা করতে পারলেই ভাষা সমস্যার সমাধান হবে।

আজকের ভারতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার ব্যবস্থা অনেক প্রসারিত হওয়া সত্ত্বেও ভাষাজ্ঞানের যে ব্যাপক দুরবস্থা, মেঘনাদ সাহার এই পরামর্শ শুনলে আমরা সে বিষয়ে একটু আশ্বস্ত বোধ করতে পারি। পাশাপাশি, এটাও কিন্তু খেয়াল করা দরকার যে, দেশে বহু মানুষের এখন ইংরেজির উপর একটা দখল আছে। এবং, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাগুলির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে জরুরি, তেমনই ভারতীয়দের ইংরেজি ভাষায় যে স্বাচ্ছন্দ্য দুনিয়া জুড়ে মানুষকে চমৎকৃত করে, তা নিয়ে সরকারের লজ্জিত বোধ করারও কোনও কারণ নেই। বস্তুত, ইংরেজি তো এখন একটি ভারতীয় ভাষায় পরিণত। ভারতের মানুষ চিরকালই একাধিক ভাষার চর্চা করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তখ্ত থেকে হুকুম জারি করে একটা অভিন্ন এবং প্রায় উদ্ভট সরকারি হিন্দি গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দিয়ে এই বহুত্বকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE