একটি বিষয়ে এ দেশে সকল রাজনৈতিক দলই সম্পূর্ণ একমত: উচ্চশিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ চাই। এই সর্বজনীন আকুলতার পিছনে ঠিক কোন চিন্তাটি আছে, উচ্চশিক্ষার মতো মূল্যবান উত্তরণ-সোপান সকল মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছাইয়া দিবার ব্রত, না কি শিক্ষার নামে দানছত্র-নীতি দিয়া ভোটদাতা-তোষণ, সেই জটিল সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্নে আপাতত ঢুকিবার দরকার নাই। কেবল লক্ষণীয় যে, ইউপিএ সরকারের সহিত নূতন মোদী সরকারের যত ঝগড়াই থাকুক না কেন, একটি জায়গায় ইহারা একমত: তাহা হইল, উচ্চশিক্ষা, এমনকী একেবারে উপরের ধাপের উত্কর্ষমুখী শিক্ষা, সবটাই যেন তেন প্রকারেণ আসমুদ্রহিমাচল আমজনতার নাগালে আনিয়া দিবার দুর্মর বাসনা। তাই ইউপিএ সরকারের আমলে যেখানে আটটি নূতন আইআইটি তৈরি হইয়াছিল, নূতন বিজেপি সরকার সেখানে তাহার প্রথম বাজেটেই পাঁচটি প্রদেশে পাঁচটি নূতন আইআইটি এবং অন্য পাঁচটি প্রদেশে নূতন আইআইএম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়াছে। শুধু তাহাই নহে। আগামী কয়েক বত্সরের মধ্যে প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব আইআইটি এবং আইআইএম গড়িয়া দিবার অঙ্গীকারও শোনা গিয়াছে। অর্থ যদিও মঞ্জুর হইয়াছে মাত্র পাঁচ শত কোটি, যাহা একটি প্রতিষ্ঠান গড়িবার পক্ষেও অপ্রতুল, কিন্তু তাহা দ্বিতীয় গোত্রের সমস্যা। প্রাথমিক সমস্যাটি উচ্চশিক্ষা-বীক্ষার মধ্যেই।
আসল কথা, মুড়িমুড়কির মতো ‘উত্কর্ষ প্রতিষ্ঠান’ স্থাপনা করিলে সর্বপ্রথমেই উত্কর্ষকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। এই পুরাতন প্রতিষ্ঠানগুলি এত দিন ধরিয়া উত্কৃষ্ট থাকিয়াছে, আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠতার তালিকায় অবিচল থাকিয়াছে, কারণ ইহাদের উত্কর্ষ এত দিন যাবত্ কষ্ট করিয়া বজায় রাখা হইয়াছে। ছাত্রছাত্রীর মান, শিক্ষকদের যোগ্যতা, পরিকাঠামোর সমঞ্জসতা, এই সমস্ত কিছু নিশ্চিত না করিলে উত্কর্ষকেন্দ্র হয় না। এত মহাঘর্র্ উত্কর্ষমুখী শিক্ষা কি সত্যই আমজনতার জন্য দরকার, না কি বিদ্যাবুদ্ধির নিক্তিতে ছাত্রসমাজের সেরা অংশটিরই তাহা প্রাপ্য? ইহা কোনও জিজ্ঞাসা নয়। প্রশ্নাকারে সাধারণ বোধের উত্থাপন মাত্র।
বাস্তবিক, সেরা মানের শিক্ষক কিংবা পরিকাঠামো কোনওটিই তো সহজলভ্য কিংবা শস্তা নহে। এই জন্যই ইউ পি এ আমলে যে প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি হইয়াছিল, যথাযথ পরিকাঠামোর অভাবে, যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতায় সবই বেদম ধুঁকিতেছে। অসমের আই আই এম কিংবা ছত্তীসগঢ়ের আই আই টি-তে বিশ্বমানের শিক্ষকদের নিয়োগ করিতে হইলে যে অর্থ প্রয়োজন, তাহা নিশ্চিত করিতে হইলে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এ ভাবে বল্গাহীন ভাবে বাড়ানো যায় না। রাজনীতি-পাঠের পাশাপাশি এই সামান্য হিসাবটুকুও বাঞ্ছিত। অর্থ যেহেতু সীমাহীন নয়, ইহজগতেও নয়, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের বাজেট-খাতাতেও নয়, তাই পরিকল্পনা ঘোষণার পিছনে একটু বাস্তববোধ চাই। আমজনতার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার মতো আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত করার পরিকল্পনা গণতন্ত্রের নামে জনগণের অর্থের নয়ছয় ছাড়া কিছু নহে। অতীত অভিজ্ঞতাই চোখে আঙুল দিয়া দেখায়, আই আই টি এবং আই আই এম-এর এমন মাত্রাহীন বিস্ফোরণে উচ্চশিক্ষাও কলিকা পায় না, গণদেবতাও প্রসন্ন হন না। গোটাটাই প্রহসন হইয়া দাঁড়ায়। আশ্চর্য সমদর্শিতা এবং অর্থহীনতার সহিত বর্তমান সরকারও সেই প্রহসন-ট্র্যাডিশনের অঙ্গী হইল। কারণ সহজ। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন যে শিক্ষার জন্য নহে, রাজনীতির জন্য, তাহা তো দলমতবর্ণ-নির্বিশেষে সকল নেতাই বিলক্ষণ অবগত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy