ব্যাধি এবং তাহার উপসর্গ এক নহে। পরিষদীয় সচিব নিয়োগের আইন করিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে অপচেষ্টায় মাতিয়াছিল, কলিকাতা হাইকোর্টের রায়ে তাহা নাকচ হইবার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হইতে পারে, কারণ এই ধরনের প্রাপ্তিযোগের ব্যবস্থা অন্য রাজ্যেও দেখা গিয়াছে, সেখানেও এই রায়ের প্রতিক্রিয়া সম্ভব। ‘পরিষদীয় সচিব’-এর তকমায় কার্যত আরও একগুচ্ছ মন্ত্রী নিয়োগের এই তৎপরতা কোনও স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই মানা যায় না। কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা অনেক বেশি গুরুত্ব দেন পাটোয়ারি বুদ্ধিকে, যে বুদ্ধি সরকারি যন্ত্র এবং জনসাধারণের অর্থে সমৃদ্ধ কোষাগারকে দলীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহারের কুমন্ত্রণা দেয়। সেই কুমন্ত্রণার বশীভূত হইয়াই পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিনায়িকা এই অতি-মন্ত্রী বানাইবার আইন করিয়াছিলেন। বিচারবিভাগের বিচক্ষণতায় সেই অপকর্ম আপাতত প্রতিহত। কিন্তু এই ধরনের অপপ্রয়াস যে জটিল অসুখের পরিণাম, তাহার শিকড় গভীরে, ভারতীয় শাসনতন্ত্রের মূলে প্রোথিত। সেই শিকড়টি উৎখাত না করিলে এই ধরনের উপসর্গ আরও অনেক দেখা যাইবে।
রাজ্য সরকারের আইন প্রণয়নের পরে প্রশ্ন উঠিয়াছিল: মন্ত্রিসভার পরে আবার পরিষদীয় সচিবের প্রয়োজন কী? সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু তাহারও আগে আছে আর একটি সঙ্গত প্রশ্ন: এত মন্ত্রীর প্রয়োজন কী? কেবল পশ্চিমবঙ্গে নহে, গোটা দেশেই, রাজ্য ও কেন্দ্র উভয় স্তরেই, প্রশ্নটি সঙ্গত। এমনকী ‘ন্যূনতম সরকার’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়া ক্ষমতায় আসিবার পরে নরেন্দ্র মোদীও বৃহতের আকর্ষণ পুরোপুরি ত্যাগ করিতে পারেন নাই। এই অতিকায় মন্ত্রিসভার একটি বড় অংশের প্রকৃতপক্ষে কোনও প্রয়োজনই নাই, নাই বলিয়াই বিভিন্ন জমানায় অনেক রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীকে যথেষ্ট মর্যাদা না পাইবার অভিযোগ তুলিতে শোনা গিয়াছে— তাঁহাদের নাকি কাজ দেওয়া হয় না! কাজ না থাকিলে কাজ কোথা হইতে দেওয়া হইবে, এই সহজ প্রশ্নটি তোলা হয় না। তোলা দরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মন্ত্রী তথা সচিবের সংখ্যা পনেরো, ভারতে ক্যাবিনেট মন্ত্রীই ইহার দ্বিগুণ, রাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় তিনগুণ। কাজ কি আকাশ হইতে পড়িবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্তটি অন্য কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে মন্ত্রিসভার সদস্যরা কংগ্রেস হইতে মনোনীত হন না, প্রেসিডেন্ট তাঁহাদের মনোনীত করেন, তাহার পরে তাঁহাদের আইনসভার আস্থা অর্জন করিতে হয়। ইহার ফলে দুই বিভাগের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ থাকে। ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের অনুসারী ভারতীয় শাসনতন্ত্রে মন্ত্রীরা আইনসভার সদস্য। এই রীতির ফলে আইনবিভাগ এবং শাসনবিভাগের কাজের মধ্যে যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা যায় না। তাহার একাধিক কুফল। একটি কুফল ইহাই যে, আইনসভার কাজে বড় রকমের ফাঁকি পড়ে। তাহার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে, যখন দেখা যায়, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় গুরুতর ত্রুটি ঘটিতেছে, সাংসদরা যথেষ্ট মনোযোগী হইলে যে ত্রুটির সম্ভাবনা কম হইত। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অধুনা-কুখ্যাত ৬৬এ ধারাটির ইতিহাস স্মরণীয়। এই আইন যখন সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে বিচার করা হয়, তখন সেই কমিটির অভিজ্ঞ এবং শিক্ষিত সদস্যরাও এই ভয়ঙ্কর ধারাটিকে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন! আর কোনও কারণে না হোক, আইনসভার কাজে উন্নতিসাধনের জন্যও মার্কিন দৃষ্টান্তটি হইতে শিক্ষণীয় রহিয়াছে। প্রেসিডেন্টশাসিত ব্যবস্থায় না গিয়াও মন্ত্রিসভাকে আইনসভা হইতে স্বতন্ত্র করা সম্ভব, সংসদের নিকট সেই মন্ত্রিসভার দায়বদ্ধতার তাহাতে হানি ঘটিবে না। অবশ্যই ইহা শাসনতন্ত্রের মৌলিক সংশোধনের প্রশ্ন। সেই কারণেই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাধির চিকিৎসা মৌলিক হওয়াই জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy