এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অযথা কেন্দ্রীকরণের দিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইবার যে ঝোঁক, ক্রমশই তাহা একটি বড়সড় বিপদে পরিণত হইতেছে। দেখা যাইতেছে, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীভূত শিক্ষা চালু করিলেই তাহা সুষ্ঠু ও সুফলদায়ক— এই বিশ্বাসটি এতই বহুপ্রসারিত ও গভীরচারিত যে, দুমদাম রাতারাতি সংস্কারেও কাহারও আপত্তি নাই, তাহাতে ছাত্রসমাজ হতচকিত হইয়া গেলেও না। গোটা দেশ জুড়িয়া এক ও অদ্বিতীয় মেডিক্যাল টেস্ট চালু করিবার শাসন-বিভাগীয় প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্টের যে সিলমোহর পড়িল, তাহা চলতি বৎসর হইতেই প্রযুক্ত হইবে। অর্থাৎ বিভিন্ন কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য যে ছাত্রছাত্রীরা একাধিক বৎসরের প্রস্তুতি লইয়া পরীক্ষায় বসিতে একেবারে প্রস্তুত, তাহাদের রাতারাতি একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার আওতায় লইয়া আসা হইল। ইহার ফলে তাহাদের মানসিক কিংবা সারস্বত ক্ষতি হইলে কী-ই বা আসে-যায়, কেননা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত, ভবিষ্যতে আপামর ছাত্রছাত্রীকুলের ইহাতে অপরিসীম উপকার হইবে। বড় লাভের জন্য ছোট ক্ষতি মানিয়া লওয়া কিংবা বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে শেখা ইত্যাদি অতীব সুশিক্ষা, সন্দেহ নাই। তবে কিনা, মাথায় সংস্কারের মুগুর মারিয়া সেই শিক্ষা দিবার পদ্ধতিটি মঙ্গলদায়ক কি না, সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ রহিল। বিশেষত যেখানে ‘বড় লাভ’ আদৌ হইবে কি না, তাহাই একটি বিশালাকার প্রশ্নচিহ্ন, সেখানে তো বিতর্ক আরওই জোরদার হইবার কথা।
বড় কেন, এই সংস্কারে কোনও ছোট লাভও হইবার কথা নহে। নানা মানের নানা প্রতিষ্ঠানে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ঢুকিবার ব্যবস্থা হইলে উত্তম প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষতি স্পষ্ট, অধম প্রতিষ্ঠানগুলিরও কোনও প্রকার লাভ নাই। শিক্ষা বস্তুটিই যেহেতু অতি অসম, কে কোন মানের শিক্ষা লইতে সক্ষম ও উৎসাহী, তাহা বুঝিবার সোপান এই প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলি। ফলে ভাল প্রতিষ্ঠান সেই পরীক্ষার মান উচ্চে রাখিবে, তাহাই স্বাভাবিক। তাহাতে বিঘ্ন ঘটিলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মূল্যায়নের অবকাশটিও ভয়ানক ক্ষীণ হইয়া যাইবে। সব মিলাইয়া, দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার সার্বিক মানটিই পড়িয়া যাইতে বাধ্য। এই সহজ যুক্তিটি কোনও ক্ষেত্রেই ভারতের নিয়ামকরা বুঝিতে চাহেন না। তাঁহাদের না বুঝিবার মূল্য দিতে হইতেছে গোটা সমাজকে, শিক্ষামানের ক্রম-তরলীকরণের মধ্য দিয়া।
অথচ এক বার চোখ মেলিয়া বাহিরের পৃথিবীর দিকে তাকাইলেই বোঝা যাইত, ভারত হনহন করিয়া চলিতেছে বাকি বিশ্বের ঠিক উল্টা অভিমুখে। প্রথমত, উন্নত দেশগুলিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর এমন বেপরোয়া সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা নাই, দ্বিতীয়ত, উৎকর্ষের উচ্চতর মানে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলিকে ক্রমশই আরও বেশি করিয়া আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হইতেছে। ভারত তবুও ঘুমায়ে রয়। ভারতের যে রাজ্যগুলি এই সংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তিতে গলা ফাটাইতেছে, তাহাদের প্রতিও একই সমালোচনা প্রযোজ্য। কেন্দ্রীকরণ নহে, বিকেন্দ্রীকরণ চাই, ইহার অর্থ অন্তত শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন। কেন্দ্রীয় সরকারের বদলে রাজ্য সরকারের দণ্ড নামিয়া আসিলেও রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কিছু উপকার হইবে না। বরং সব প্রকারের সরকার একটু পিছাইয়া দাঁড়াইলে ভাল। শত পুষ্প নিজেরাই নিজেদের বিকশিত করিতে পারিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy