Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

এনবিডি

গ্রি ক চলচ্চিত্রকার থিয়ো অ্যাঞ্জেলোপলুস-এর একটি ছবিতে প্রধান চরিত্রটি শব্দ খুঁজিয়া বেড়াইত। ইতিহাসের একটি সময়কে পুনর্নির্মাণ করিতে চাহিলে সেই সময়ের শব্দগুলি সংগ্রহ করিতে হয়। চরিত্রটি সেই সাধনায় ব্যাপৃত ছিল। থিয়ো বাঁচিয়া থাকিলে দেখিতেন, গ্রিসের দৌলতে সম্প্রতি একটি নূতন শব্দ অক্সফোর্ড অভিধানে প্রবেশ করিয়াছে। গ্রেক্সিট। গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকিবে কি থাকিবে না, সেই দোলাচলের পটভূমিতেই শব্দটির উৎপত্তি।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

গ্রি ক চলচ্চিত্রকার থিয়ো অ্যাঞ্জেলোপলুস-এর একটি ছবিতে প্রধান চরিত্রটি শব্দ খুঁজিয়া বেড়াইত। ইতিহাসের একটি সময়কে পুনর্নির্মাণ করিতে চাহিলে সেই সময়ের শব্দগুলি সংগ্রহ করিতে হয়। চরিত্রটি সেই সাধনায় ব্যাপৃত ছিল। থিয়ো বাঁচিয়া থাকিলে দেখিতেন, গ্রিসের দৌলতে সম্প্রতি একটি নূতন শব্দ অক্সফোর্ড অভিধানে প্রবেশ করিয়াছে। গ্রেক্সিট। গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকিবে কি থাকিবে না, সেই দোলাচলের পটভূমিতেই শব্দটির উৎপত্তি। অভিধান এ বার তাহাকে মান্যতা দিল। হ্যাংরি, এনবিডি-র মতো আরও সহস্র লোকপ্রিয় শব্দবন্ধ সেখানে স্থান পাইল। ভাষাবিদরা কেহ কেহ তর্ক তুলিবেন, যাহাই লোকমুখে প্রচলিত, তাহাই মান্য করিলে ভাষার অবনমন অবশ্যম্ভাবী। আশঙ্কাটি উড়াইয়া দিবার নহে। কিন্তু ভাষার শুদ্ধতার প্রশ্নটি মাথায় রাখিলেও একটি সত্য তর্কাতীত। নিত্যনূতন শব্দের জন্মই ভাষাকে চলিষ্ণু রাখে। বদ্ধ জলাশয় মানেই মৃত্যুর পরোয়ানা। এইখানে ইংরাজির সহিত বাংলা ভাষার তুলনা অনিবার্য। এবং তাহা বিশেষ স্বস্তিদায়ক নহে।

ইংরাজি ভাষাটির নিরন্তর মন্থন হইতেছে। ভালমন্দ যেমনই হউক, শব্দভাণ্ডারে উত্পাদন ও আমদানি থামিয়া নাই। তাহার পাশে বাংলা যেন মজা খাত। কেহ বলিবেন, ইংরাজি ভুবনের ভাষা। সেই ভাষায় যে পরিমাণ নাড়াচাড়া হইবে, বাংলায় তাহা আশা করাই ভুল। কথাটি কেবল অর্ধসত্য। ভাষার গতিজাড্য শুধু সংখ্যার উপরে নির্ভরশীল নহে। ভাষাচর্চার গুণমান এবং নিত্যতাও একটি নির্ণায়ক শক্তি। বাংলা সেইখানে মার খাইতেছে সর্বাপেক্ষা অধিক। নূতন শব্দ গঠন দূরে থাক, দেরাজে রাখা আপন শব্দরাজিও এ বঙ্গের বাঙালি ভুলিতে ব্যস্ত। বোঝাপড়ার বদলে সমঝোতা, সুস্বাদুর জায়গায় স্বাদিষ্ট বলিয়া সে অধুনা তৃপ্ত। মুড়িমুড়কির মতো ইংরাজি এবং হিন্দি শব্দ না গুঁজিয়া বাক্য গঠনের ক্ষমতা লুপ্তির পথে। ভাষাকে ঘিরিয়া যে আত্মাভিমান তাহার উর্বতাকে রক্ষা করে, বাঙালির অভিধানে তাহাই যেন আজ অন্তর্হিত। যে তলানিটুকু পড়িয়া আছে, তাহা সময় সময় অশিক্ষা আর কূপমণ্ডূকতার বেশে ইংরাজির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণায় আত্মপ্রকাশ করে। অথচ ইংরাজির সংশ্লেষেই বাংলা গদ্যভাষার জন্ম। সেই উত্তরাধিকারই তাহার বিশ্বায়নে পাথেয় হইতে পারিত। নিজ দোষেই বাঙালি সে সুযোগ হারাইয়াছে।

এই পরিণতির ইঙ্গিত গত কয়েক দশকের ইতিহাসে নিহিত ছিল। মধ্যমেধার উপাসনায় প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরাজির বিদায়, তৎসহ সরকারি শিক্ষায়তনগুলির দুর্দশা বঙ্গীয় শৈশবের বড় অংশকে অন্য বোর্ডের বিদ্যালয়ে পাঠাইল। তাহাদের পাঠ্যক্রমে বাংলা দুয়োরানি। তত্সহ অন্ধ রাজনীতি আর বন্ধ্যা অর্থনীতির চোরাবালিতে বাঙালির সামগ্রিক ন্যুব্জ দশা বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎকেও অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করিল। শিক্ষিত বাঙালির চিন্তনের ভাষাটি আজ আর বাংলা নহে। কদাচিত্ যদি বাংলা লিখিতে হয়, ইংরাজি পরিভাষার চটজলদি তর্জমা করিয়াই তাঁহারা কাজ সারেন। নূতন শব্দের উদ্ভাবনে কালক্ষেপ করেন না। অথচ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিই এক দিন আটলান্টিকের বাংলা অতলান্তিক, প্যাসিফিকের বাংলা প্রশান্ত মহাসাগর ভাবিয়াছিল। বর্তমানের বাঙালি শখ করিয়া ভুল বানান ও ব্যাকরণ সহযোগে স্মার্টফোনের বাংলা হরফে ফেসবুকে ‘স্টেটাস’ লিখিতেছে। কিন্তু অদ্যাবধি সোশ্যাল মিডিয়ার একটি বাংলা প্রতিশব্দ ভাবিয়া পায় নাই। তাহাতে কী? জবাব আসিবে, এনবিডি! নো বিগ ডিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE