Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

এর বেশি হয় না

‘তোমরা আমাকে ভোট দাও, তোমাদের হাতে চাঁদ এনে দেব’ বলে বেড়ালে লোকের আশাও আকাশে ওঠে। অর্থমন্ত্রী সেই প্রত্যাশা মেটাবেন কী করে?আজ আমরা জীবনমৃত্যুর ভাগাভাগিটাকে চরম জায়গায় নিয়ে যেতে শিখেছি। আগে এই বিভাজন অতটা ছিল না। জীবনবোধ আগেও ছিল, মৃত্যুবোধ ছিল। কিন্তু এ দুইয়ের মাঝে এক অতীন্দ্রিয় জগৎ ছিল। আজও আছে, কিন্তু এক স্থূল বস্তুবাদের প্রভাবে আমাদের মধ্যে এই অতীন্দ্রিয় বোধ ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। উন্নততর সমাজে দয়া সহানুভূতি মায়া মমতা সহমর্মিতা আরও বেশি থাকবে। অর্থ ও ব্যক্তিসর্বস্বতার মাপকাঠিতে যেহেতু জীবন বা মৃত্যু কোনওটারই নির্দয় বিচার হবে না, তাই কারও চলে যাওয়াকে আমরা মায়ামমতা দিয়ে বেশি করে দেখব। চিকিৎসাশাস্ত্রের নির্দয় নিয়ম দিয়ে নয়। স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘দুয়ারটুকু থাক’ (১৮-১) পড়ে খুব ভাল লেগেছিল,তবু উপরোক্ত কারণে বলব, চিরন্তন কাল মানুষ যেন বলতে পারে ‘যেতে নাহি দিব’।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

পরশুরাম পড়া থাকলে অরুণ জেটলি নিশ্চয়ই বলতেন: ভারত চড়িতেছে, দুনিয়া নামিতেছে। তাঁর বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই ভারতের অর্থমন্ত্রী বড় মুখ করে সব্বাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বাকি পৃথিবীতে যখন অর্থনীতির গতিভঙ্গ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই, ভারত তখন উড়ে যাওয়ার জন্য রেডি স্টেডি। কথাটা মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। সম্প্রতি আইএমএফ নতুন হিসেব দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অগ্রগতি আগে যতটা হবে ভাবা হয়েছিল, হবে তার চেয়ে কম। আর, ভারতের আয়বৃদ্ধি? কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার সংশোধিত পরিসংখ্যান অনুসারে, জিডিপি বাড়ছে, ৫ নয়, ৬ নয়, একেবারে ৭.৪ শতাংশ। এবং, রাখে কপাল মারে কে, এ-সব হচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন চিনের অনন্ত-দৌড়ের গতি, শেষ পর্যন্ত, কমে আসছে। নরেন্দ্র মোদী শি চিনফিংকে শুনিয়ে দিতে পারেন: তুমি অরুণাচল নিয়ে টানাটানি করতে থাকো, আমি তোমাকে জিডিপিতে মেরে দিয়েছি!

মোদী এবং তস্য অর্থমন্ত্রীর কপাল সত্যিই ভাল। অচ্ছে দিন আনবেন বলে যে-ই না গদিতে বসা, অমনি ছপ্পর ফুঁড়ে সুদিন আগত ওই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম হু হু করে পপাত চ মমার চ। অতএব বাজেট পড়তে গিয়ে অর্থমন্ত্রী এই আশ্চর্য কথাটি বলার দুর্লভ সুযোগ পেয়ে গেলেন যে, ‘পাইকারি বাজারদর এখন কমছে’! কিংবা, ‘যখন আমরা ক্ষমতায় আসি, তখন কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট (মোটের ওপর, আমদানি-রফতানির ফারাক) ছিল জিডিপি’র ৪.৬ শতাংশ, আর এখন সেটা মাত্র ১.৩ শতাংশ’। ভাবখানা হল, আগের জমানায় দেশের অবস্থা কী খারাপই না ছিল, আর আমরা এসেই ন’মাসের মধ্যে তাকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছি।

দেশের অবস্থা যা দিয়ে মাপা হয়ে থাকে, যেমন জিডিপি বৃদ্ধির হার কিংবা মূল্যবৃদ্ধি, সে সব দিক থেকে আগের জমানায়, মানে দ্বিতীয় ইউপিএ’র আমলের রেকর্ড সত্যিই বেশ খারাপ। তার পিছনে সেই জমানার শাসকদের দায়ও অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই তুলনায় এখন অবস্থায় যে উন্নতি হয়েছে, তার পিছনেও যদি সরকারি নীতি বা কাজকর্মের কোনও অবদান থেকে থাকে, তবে সেটা অনেকাংশেই ওই ইউপিএ জমানারই। নরেন্দ্র মোদী সংসদ ভবনের সিঁড়িতে মাথা ছুঁইয়ে দিল্লির দরবারে আবির্ভূত হলেন, বারাণসীর ঘাটে রুদ্রাভিষেক করলেন আর অমনি জিডিপি উঠতে লাগল এবং বাজারদর পড়তে লাগল, এমনটা নিশ্চয়ই তিনিও বিশ্বাস করেন না।

আসল ব্যাপারটা সোজা। অনেক দিন আগে, নব্বইয়ের দশকে মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান রোনাল্ড রেগনের জমানা সম্পর্কে সেই সোজা কথাটা বলেছিলেন। ক্রুগম্যানের বক্তব্য ছিল: অর্থনীতি তার নিজের তালে চলে, যাঁরা সরকার চালান কিংবা যাঁরা সেই সরকারকে উপদেশ দেন তাঁরা মনে করেন তাঁদের কেরামতি। রেগনের আমলে আমেরিকার যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ক্রুগম্যানের মতে তার পিছনে রেগনের উপদেষ্টাদের ভূমিকা ছিল যৎসামান্য, বেশির ভাগটাই স্বাভাবিক উত্থানপতনের খেলা। ক্রুগম্যান রেগনের রাজনীতি পছন্দ না করলেও কিছু দিন পরোক্ষে রেগন সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন, সুতরাং বলতে হবে, ঠেকে শিখেছেন! তাঁর কথা বেদবাক্য নয় নিশ্চয়ই, সরকারি নীতি দিয়ে অর্থনীতির গতি পালটানো যেতেই পারে, কিন্তু তার জন্যে সময় লাগে। কালক্রমে নরেন্দ্র মোদী হয়তো ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠবেন, চাই কী পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অবিনশ্বরও হতে পারেন, কিন্তু সে-সব ক্রমশ প্রকাশ্য, এখনও অবধি তিনি এমন কিছু করেননি যার ফলে দেশে জিডিপির বান ডাকবে। সেই হিসেবে অরুণ জেটলির অহঙ্কারটা একটু খেলো শোনাল।

এমনকী অহঙ্কার করতে গিয়ে মন্ত্রিবর অন্তত একটা ব্যাপারে কিঞ্চিৎ বেসামালও হয়ে পড়েছেন আগের জমানায় চড়া বাজারদরের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ২০১২ নভেম্বরে মূল্যবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশ, আর এখন শূন্যেরও কম। মনমোহন সিংহ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না তাই, না হলে নিশ্চয়ই অনুযোগ করতেন: ‘আমি তো ২০১৪’র মে অবধি ছিলাম, তা হলে তুলনাটা তার দেড় বছর আগের সঙ্গে কেন, স্রেফ ওই সময় বাজারদর খুব বেশি বাড়ছিল বলেই?’

তবে ও-সব ছোটখাটো কথা ধরতে নেই। রাজনীতি করতে হলে পরিসংখ্যান নিয়ে একটু-আধটু কারসাজি না করলে চলে নাকি? ঠিক যেমন, ‘মনরেগা’ বা গ্রামীণ রোজগার যোজনায় ‘রেকর্ড’ বরাদ্দ করার ব্যাপারটা। রেকর্ডটা কী রকম? ভেঙে বললে দেখা যাবে, চলতি বছরে মনরেগায় যত টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, আগামী বছরের বাজেটের বরাদ্দ তার চেয়ে সামান্য বেশি, অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির হিসেব ধরলে প্রকৃত বরাদ্দ কিছুটা কম রাখা হচ্ছে। কিন্তু তার পরে একটা অদ্ভুত ‘ইতি গজ’ আছে: যদি রাজস্ব আদায় খুব ভাল হয়, তা হলে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে আরও পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি দেওয়া হবে। সাধারণ বুদ্ধিতে দেখলে, এ ভারী বিচিত্র কথা। যদি সরকার মনে করে, মনরেগায় আরও বেশি টাকা বরাদ্দ করা দরকার, তা হলে করবে, না হলে করবে না, কত টাকা রাজস্ব আদায় হল, তার সঙ্গে বাড়তি বরাদ্দের কী সম্পর্ক? সেই যুক্তিতে তো সমস্ত খাতেই ব্যয়বরাদ্দ বাড়তি আদায়ের ওপর নির্ভরশীল

হওয়ার কথা।

সন্দেহ হয়, আসলে গরিব মানুষকে কাজ দেওয়ার এই আয়োজনটি ওঁদের মোটেই পছন্দ হয়, তাই প্রাণে ধরে বেশি বরাদ্দটা করতে পারছেন না, আবার মনে ভয়ও আছে যে, ‘এই সরকার গরিবের সরকার নয়’ বলে রব উঠবে, অতএব ‘আয় বেশি হলে আরও কাজ দেব’ গোছের একটা খুড়োর কল ঝোলাতে হল। কিন্তু তা হলেও একটা কথা না বললে চলে না। এই হলেও-হতে-পারে বরাদ্দবৃদ্ধিকে রেকর্ড বলে জাহির করাটা ঠিক হল কি? যে কোনও খাতে সরকারি খরচ এক টাকা বাড়ালেও তো ‘রেকর্ড’ হয়, সেই রেকর্ড নিয়ে আমরা খাব না মাথায় মাখব? তবে হ্যাঁ, ওই, পরিসংখ্যানের কোনও জবাব নেই। এক বার কোনও একটা প্রশ্নের উত্তরে আইনসভায় এক মন্ত্রী সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন, এক বছরে একটি এলাকায় হাসপাতালের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। চেপে ধরতে প্রকাশ হল, আগে একটা হাসপাতাল ছিল, এখন দুটো হয়েছে। অরুণ জেটলির রেকর্ড বরাদ্দের বাগাড়ম্বর শুনে সেই কাহিনি মনে পড়ে গেল।

অর্থমন্ত্রী ভুল বুঝবেন না, তাঁর বাজেটটি বেশ হয়েছে। যেমনটি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব ছিল, করেছেন। মুশকিল হয়েছে কি, লোকে আরও অনেক প্রত্যাশা করেছিল। তাঁর দোষ নয়, দোষ তাঁর প্রধানমন্ত্রীর। প্রশস্তবক্ষ বাজাতে বাজাতে ও-রকম করে ‘তোমরা আমাকে ভোট দাও, আমি তোমাদের হাতে চাঁদ এনে দেব’ বলে লোভ দেখিয়ে বেড়ালে লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষাও আকাশে ওঠে। গরিব মানুষের আশাও নেই, আকাঙ্ক্ষাও নেই, কিন্তু সবাই তো আর গরিব মানুষ নয়। অর্থমন্ত্রী সেই আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা মেটাবেন কী করে? তাই বলছি, এর বেশি হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE