অ রুণ শৌরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সুযোগ দিয়াছেন। একটি নয়, দুইটি সুযোগ। প্রথম সুযোগ আপন বিচক্ষণতা প্রমাণের, দ্বিতীয় সুযোগ আত্মসংশোধনের। বিচক্ষণ নেতা প্রশংসা অপেক্ষা সমালোচনাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন, অপ্রিয় কথা অনেক বেশি মনোযোগ সহকারে শোনেন। নরেন্দ্র মোদীর সহকর্মীরা সেই পরীক্ষায় ফেল করিয়াছেন। তাঁহারা অরুণ শৌরির তিরস্কারে ক্ষোভ এবং বিরাগ প্রকাশ করিয়াছেন, এই তিরস্কারকে ব্যক্তিগত আশাভঙ্গের পরিণাম হিসাবেও ব্যাখ্যা করিয়াছেন। নিন্দার মুখোমুখি হইলেই নিন্দুকের মুণ্ডপাত করিবার অভ্যাস ভারতীয় রাজনীতিতে পরিব্যাপ্ত, বিজেপি নেতারাও তাহার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারেন নাই। নরেন্দ্র মোদী পারিবেন কি? যথার্থ বিচক্ষণ হইলে তিনি সমালোচকের উদ্দেশ্য লইয়া তিলমাত্র মাথা ঘামাইবেন না, সমালোচনার সারটি বিবেচনা করিবেন। তাঁহাকে সর্বাগ্রে বুঝিতে হইবে যে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিরা ব্যক্তি লইয়া ভাবিত হয়, যিনি ক্ষুদ্র নহেন, তিনি নীতি বা ধারণা লইয়া চিন্তা করেন।
ভারতীয় জনতা পার্টির ঘনিষ্ঠ রাজনীতিক এবং ভূতপূর্ব এনডিএ সরকারের বিলগ্নিকরণ দফতরের মন্ত্রী অরুণ শৌরি মোদী সরকার সম্পর্কে একাধিক অভিযোগ আনিয়াছেন। অভিযোগগুলির মূল কথা: এই সরকার যত গর্জাইয়াছিল, সেই অনুপাতে কিছুই বর্ষায় নাই। কথাটি উড়াইয়া দিবার কোনও উপায় নাই। বস্তুত, বিভিন্ন অর্থনীতিবিশারদ হইতে শুরু করিয়া শিল্পোদ্যোগী, এমনকী বিজেপির একাধিক সহমর্মী ও শরিক দল অবধি নানা মহল হইতে এই একই অভিযোগ ক্রমশ প্রবল হইতেছে: কিছুই তো হইল না! মন্ত্রিত্ব না পাইবার হতাশাবশত হউক অথবা অন্য যে কারণেই হউক, অরুণ শৌরি সেই ক্রমবর্ধমান ধারণাটি প্রকাশ করিয়াছেন। প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য, এই সমালোচনাকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া এবং নিজের ব্যর্থতার কারণগুলি চিহ্নিত করিয়া সেগুলি দূর করিতে যত্নবান হওয়া। অর্থাত্, এক কথায়, আত্মসংশোধন।
ঝাঁটা হাতে রাস্তা সাফ করা বা উমা ভারতীর নেতৃত্বে গঙ্গা শোধন করার মতো সহস্র কাজ চলিতে থাকুক, ক্ষতি নাই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সর্বাগ্রে স্থির করিতে হয়, তাঁহার প্রথম ও প্রধান কাজ কী। সেই কাজটির নাম: বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা। ভারতীয় অর্থনীতি দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় যে গতিভঙ্গের শিকার হইয়াছিল, গত এক বছরে তাহা হইতে হাল কিছুটা ফিরিয়াছে। কিন্তু তাহার প্রধান কৃতিত্ব পেট্রোলিয়মের বিশ্ব বাজারের। তেলের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় কমিবার ফলে মূল্যবৃদ্ধি প্রশমিত, বিদেশি মুদ্রার তহবিলও সুস্থিত। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও যে বিনিয়োগে জোয়ার আসে নাই, তাহাই বুঝাইয়া দেয়, পরিবেশ বিনিয়োগের অনুকূল নহে। বস্তুত, এই সরকারের একাধিক নীতি ও আচরণ বিনিয়োগের প্রতিকূল। বিদেশি বিনিয়োগের উপর ন্যূনতম বিকল্প কর (‘ম্যাট’) বসাইবার দুর্বুদ্ধি কিংবা বিদেশ ভ্রমণে গেলে তাহার হিসাবপত্র আয়কর কর্তাদের নিকট দাখিল করিবার শর্ত আর যাহাই হউক, ব্যবসার অনুকূল নহে। কিন্তু এই ধরনের নীতির মূলে যে মানসিকতা, তাহাই প্রধান বিপদ। সেই মানসিকতাকে এক কথায় রাষ্ট্রসর্বস্বতা বলা চলে। অর্থাৎ, এই সরকারের নায়করা বিশ্বাস করেন, সমাজ ও অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের কথাই শেষ কথা, রাষ্ট্রের নজরদারিই শ্রেষ্ঠ বন্দোবস্ত। ইহা আর্থিক সংস্কারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নরেন্দ্র মোদী ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক প্রশাসন’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়া ভোট চাহিয়াছিলেন। তিনি নিঃসন্দেহে সর্বাধিক সরকারের প্রতিযোগিতায় দ্রুত ইন্দিরা গাঁধীর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিতেছেন। অরুণ শৌরির তিরস্কারে যদি সম্বিৎ ফিরে, ভারতের মঙ্গল, প্রধানমন্ত্রীরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy