ধর্মাদেশ বড় না ন্যায়ের দাবি বড়? প্রশ্নটিকেই অস্বীকার করিয়া বলা যায় যে, ধর্ম ন্যায়ের বিপরীত হইতে পারে না, সুতরাং উভয়ের মধ্যে বিরোধ অসম্ভব। কিন্তু তাহাতে প্রশ্নটি নাকচ হইবে না। ধর্মের বৃহত্তর অর্থ যাহাই হউক না কেন, ধর্মাদেশ বলিতে সচরাচর ধর্মশাস্ত্রের বিধানকেই বুঝায় এবং সেই বিধান আরোপ করেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তারা। (ধর্মমতনির্বিশেষে তাঁহারা সকলেই কর্তা, কর্ত্রী বিরলতম।) শাস্ত্র ও তাহার বিধান স্বভাবত অপরিবর্তনীয়, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক অধিপতিরা তাহার পরিবর্তন চাহেন না, কারণ ধারণার মৌলবাদই তাঁহাদের অচলায়তনের শক্তির প্রধান উত্স। এই কারণেই ন্যায়ের সহিত ধর্মাদেশের বিরোধ বাধিতে পারে। বিশেষত, কালক্রমে ন্যায়ের ধারণায় বিবর্তন ঘটে বলিয়াই সেই দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা সমধিক, তাহার জটিলতাও অনিবার্য।
ভারতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে মেয়েদের প্রতি অবিচারের প্রশ্ন এই দ্বন্দ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর দৃষ্টান্ত। পুরুষের বহুবিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ঘোষণায় অনায়াস অধিকার, বিবাহবিচ্ছিন্নার খোরপোষের অনধিকার, ইত্যাদি নানা দিকে এই দ্বন্দ্ব অতি প্রকট। ভারতীয় সমাজে কার্যত ধর্মনির্বিশেষে মেয়েরা নানাবিধ সুযোগবঞ্চনার শিকার, কিন্তু আইন নিজেই যখন মৌলিক বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেয়, তখন অন্যায় নূতন মাত্রা লাভ করে। শরিয়তি বিধান তাহার আদিপর্বে হয়তো প্রগতিশীল একটি পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু যুগ বদলাইয়াছে, প্রগতির দাবি অগ্রসর হইয়াছে, বিশেষত নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের মাপকাঠিতে অনেক প্রচলিত রীতিই অন্যায় বলিয়া চিহ্নিত হইয়াছে, কিন্তু ধর্মবিধান অনড়। অনেক দিন ধরিয়াই এই অন্যায়ের প্রতিকার করিবার দাবি উঠিয়াছে, কিন্তু শাশ্বত ধর্মবিধির নামে সেই দাবির বিরোধিতাও জোরদার, এবং ভোট-কুণ্ঠিত রাজনীতি এ বিষয়ে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণে অপারগ, সুতরাং শাহবানু মামলার তিন দশক পরেও মুসলিম মেয়েরা আইনের মার খাইয়া চলিয়াছেন। হয়তো আরও অনেক কাল এই ধারাই চলিবে।
হয়তো চলিবে না। মুসলিম মেয়েদের মধ্য হইতেই এই আইনি অবিচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন এবং প্রতিবাদ ক্রমে প্রবল হইতে প্রবলতর। তিন মাস আগে তাঁহাদের একটি সংগঠন মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংশোধনে উদ্যোগ চাহিয়া প্রধানমন্ত্রী, ল কমিশন এবং জাতীয় মহিলা কমিশনের নিকট একটি আবেদন পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহাদের একটি সমীক্ষার রিপোর্টও সেই আবেদনের সহিত যুক্ত ছিল। তেরোটি রাজ্যে সম্পন্ন সেই সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, অধিকাংশ মুসলমান মেয়ে বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রচলিত বিধিব্যবস্থার পরিবর্তন চাহেন। কেন্দ্রীয় সরকার সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলি বিচারের জন্য একটি আলোচনার আয়োজন করিতে পারেন, সেখানে মুসলিম সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সমবেত হইবেন, ধর্মীয় এবং ধর্মবিধি সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানও থাকিতে পারে। সুপ্রিম কোর্টেও মুসলমান মেয়েদের সাম্যের দাবি সম্পর্কিত আবেদন লইয়া বিচার চলিতেছে। ধর্মীয় এবং ধর্মবিধি সংক্রান্ত কিছু কিছু সংগঠন জানাইয়াছে, সংখ্যালঘুর ধর্মীয় স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের সমস্ত চেষ্টা তাহারা প্রতিহত করিবে। এই বাধা অপ্রত্যাশিত নহে। কিন্তু মুসলিম সমাজের ভিতর হইতে, বিশেষত সেই সমাজের মেয়েদের মধ্য হইতে সংস্কারের দাবি যত প্রবল হইবে, বাধা অতিক্রম করিবার সম্ভাবনাও তত বাড়িবে। নরেন্দ্র মোদীর কাজ হইবে যথার্থ আলোচনার পথ প্রসারিত করা। তাঁহার দলে তথা শিবিরে অনেকেই মুসলিম মেয়েদের দাবিকে নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে লাগাইতে চাহিবেন, এমন আশঙ্কা প্রবল। ভোটের লোভে সেই ফাঁদে পা দিলে প্রধানমন্ত্রী ভুল করিবেন। বড় ভুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy