Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কোন বেলুন এ বার বিহারের মন টানছে

বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফা হয়ে গেল। পাঁচ দফার শেষে ফল জানতে আট নভেম্বর। জাতপাতের হিসেব থেকে বিহারকে বার করা মুশকিল। তবু জাতপাত ছাড়া কিছু অন্য বিবেচনাও আছে এই ভোটে।বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফা হয়ে গেল। পাঁচ দফার শেষে ফল জানতে আট নভেম্বর। জাতপাতের হিসেব থেকে বিহারকে বার করা মুশকিল। তবু জাতপাত ছাড়া কিছু অন্য বিবেচনাও আছে এই ভোটে।

 শেষ কথা। সমস্তিপুরে সুশৃঙ্খল ভোট, ১২ অক্টোবর। ছবি: এএফপি।

শেষ কথা। সমস্তিপুরে সুশৃঙ্খল ভোট, ১২ অক্টোবর। ছবি: এএফপি।

সঞ্জয় সিকদার
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:১৮
Share: Save:

উত্তেজিত যুবকটির পরনে মলিন হাফহাতা শার্ট, পাজামা। দ্বারভাঙা জেলার এক গ্রামে গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। শুরুতেই যুবকটি জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি গ্র্যাজুয়েট। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা নিয়ে সরকারি ঘোষণায় গোটা দেশ তখন উত্তাল, বিশেষ করে উত্তর ভারত। কথার গোঁড়াতেই তাঁকে বলি, ‘মণ্ডল-কমণ্ডল মে আপকা ক্যায়া লেনাদেনা?’ প্রত্যাশিত জবাব ছিল— ‘হ্যাঁ, তাই তো। আমি উচ্চবর্ণের হলেও গরিব এবং শিক্ষিত বেকার। আমার তো কোনও দিকেই লাভ নেই।’ কিন্তু জবাব তেমন এল না, বরং তিনি খরদৃষ্টিতে আমার দিকে কয়েক পল চেয়ে থেকে বললেন, ‘তো ক্যায়া চাহতে হ্যায় আপ! প্যায়ের ক্যা জুতা শর পে চঢ়হা দে!’ অথচ যুবকটির পায়ে কোনও জুতো ছিল না।

বিস্মিত হইনি। এটাই বিহারের দস্তুর। এই যে বিহারের নির্বাচন নিয়ে কত কথা বলা হচ্ছে— উন্নয়ন, সুশাসন, নরেন্দ্র মোদীর দানছত্র— কত কী। কিন্তু ফল্গুর মতো বয়ে চলেছে সেই জাতপাতের অঙ্ক— যে অঙ্ককে পুঁজি করে যুগের পর যুগ রাজনীতিকেরা আখের গুছিয়ে চলেছেন। কিছু প্রগতিশীল মানুষ এই অন্ধ ভাবনার বিরুদ্ধে বাঁধ বাঁধার চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু প্রবল বন্যার মুখে সে তো বালির বাঁধ! তাই প্রকাশ্য প্রচারে যতই গালভারী কথা বলা হোক না কেন, তলায় তলায় সেই জাতপাতের অঙ্কই জোরকদমে কষা চলছে, যেমন এতদিন চলে এসেছে। এর মূল যে কত গভীরে, একটা ঘটনা বললেই তা স্পষ্ট হবে। এক বার পটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ জানাবার জন্য একটি জার্নালিস্ট ফোরাম গড়ার উদ্যোগ হয়। মিটিং-টিটিং ডেকে সেই ফোরাম গড়াও হয়। সেই মিটিংয়ের পরে যখন চা খাওয়া চলছে, তখন দু’-এক জন এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনারা কমিটিতে আছেন ভাল কথা, কিন্তু কমিটিতে, বাবুসাহেব, ‘রাজপুত’ বেশি হয়ে গেল।’ এর থেকে বিহারবাসীর কবে মুক্তি, কোন গোত্রের উন্নয়ন সেই মুক্তি আনবে, জানা নেই।

ভোটের সময় জাতপাতের অঙ্ক মেলানো খুবই কঠিন। আমরা সাধারণ ভাবে মনে করি, জাতপাত ব্যাপারটা আড়াআড়ি বিভক্ত— উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ বা পিছড়ে বর্গ। অত্যন্ত পিছড়ে বর্গ বা দলিতদের কথাও শুনতে পাই। কিন্তু আসলে ভাগটা ঠিক আড়াআড়ি ভাগ নয়। বিহারে এবং ‘এবং উত্তরপ্রদেশেও’ জাতপাতটা সিঁড়ির মতো— অনেক ধাপ, অনেক ধরনের মানসিকতা। যেমন ভূমিহারদের মধ্যে অধিকাংশই মনে করেন উচ্চবর্ণের মধ্যে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ, তাঁদের ধারেকাছে কেউ নেই। ওই কথা শুনে ব্রাহ্মণেরা মুচকি হাসেন এবং নাকের ডগা থেকে ভনভন করা মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বলে থাকেন, ‘পুরাকাল থেকেই ব্রাহ্মণেরা বর্ণশ্রেষ্ঠ, এ নিয়ে ‘বখওয়াস’ শোনার কোনও মানে নেই। আর বাবুসাহেব তথা রাজপুতদের ‘ঘমন্ড’ বা দম্ভ নিয়ে তো হাজারো গল্প বিহারে চালু রয়েছে। বাবুসাহেবরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনও তর্কে বা যুক্তিতে যেতেই রাজি নয়। মজার ব্যাপার হল, জাতের স্বার্থে, শ্রেণির স্বার্থে বা জমির স্বার্থে এককাট্টা হতে তাদের আটকায় না। অতীতে এই স্বার্থ থেকেই ‘ব্রহ্মর্ষি সেনা’ ‘লোরিক সেনা’-র মতো অনেক প্রাইভেট আর্মি তথা লেঠেলবাহিনী গঠিত হয়েছিল। আবার ‘পিছড়ে বর্গ’-এ যাদবরাও নিজেদের সেরা বলে মনে করে। এর কারণ, নিম্নবর্ণের মধ্যে তারা তুলনায় বিত্তশালী এবং বাহুবলী তো বটেই। যাদবের লাঠির জোরের কথা সুবিদিত। এখন তো লাঠির বদলে আগ্নেয়াস্ত্র চলে এসেছে। তবু লালুপ্রসাদের নেতৃত্ব কুর্মি ও অন্যান্য পিছিয়ে-পড়া জাতরা মেনে নিয়েছিলেন, কেননা লালুপ্রসাদ তাদের ‘স্বাভিমান’ তথা আত্মসম্মানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন কিছুটা পূরণও করেছিলেন। লালুপ্রসাদের শাসনের প্রথম ভাগে মিডিয়ার কল্যাণে ‘যাদবাইজেশন’ কথাটি চালু হয়। অর্থাৎ, সব ক্ষেত্রে যাদবদের প্রতিপত্তি। প্রথম দিকে অন্য পিছিয়ে পড়া জাতের মানুষেরা তা মেনেও নিয়েছিলেন। পটনার কাছে বিক্রমে কৈরি জাতের এক মুখিয়া এক বার বলেছিলেন ‘এ বাত সহী হ্যায়, পেড়োকে ফল তো যাদবই খা রহা হ্যায়, তব ভী হমলোগোকা সায়া তো মিল রহা হ্যায়।’ কিন্তু কালক্রমে সেই সায়া তথা ছায়া থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করলেন।

বিহারে মোট ৫২টি জাতের সম্পর্কের বৃত্তান্ত কোনও গবেষক লিখলে তা মহাভারতের আয়তনকেও হার মানাবে। দুর্ভাগ্য হল, যে ‘পিছড়ে বর্গ’ বা দলিত মানুষরা উচ্চবর্ণের অবহেলা ও অত্যাচার সহ্য করেছেন, তাঁরাও কিন্তু অত্যন্ত পিছড়ে বর্গদের দূরেই ঠেলে রেখেছেন। নুনিয়া বা মুশহরদের মতো প্রান্তবাসীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা মানুষ বলে মনে করেননি, অচ্ছুত ভেবেছেন, তাঁদের দেওয়া জল স্পর্শ করেননি, এমনকী এই প্রান্তবাসীদের বহু কাল বুথের কাছাকাছি ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। তাঁরা দূরে কোনও গাছতলায় জটলা করে দেখেছেন গণতন্ত্রের মহোৎসব। এখন দিন কিছুটা বদলেছে, ভোটের সময় তাঁদের দরজাতেও করজোড়ে নেতারা হাজির হন। আবার প্রয়োজনমতো ভয় বা প্রলোভনও দেখান।

আত্মসম্মান ও অধিকারের কথা বলে অনেক আশা জাগিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষকে অনেকটা এক ছাতার তলায় আনতে পেরেছিলেন লালুপ্রসাদ। এমনকী মুসলমানদের একটি অংশও তাঁর ওপরে আস্থা রাখতে শুরু করেছিল। এর পর লালুপ্রসাদের সেই এম-ওয়াই তত্ত্বের প্রচার মুসলমানদের মনে ভরসা বাড়িয়ে তুলেছিল। লালুপ্রসাদ বুঝিয়েছিলেন, এম অর্থাৎ মুসলমান এবং ওয়াই অর্থাৎ যাদবেরা এক হলে রাজ্যটিকে তিনি বদলে ফেলবেন। রাজ্য কিন্তু বদলায়নি, বদলেছেন লালুপ্রসাদ নিজেই। মুসলমানদের মধ্যে অচিরেই এই ভাবনা চারিত হল যে, লালুপ্রসাদ কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের মুসলমানদের কথাই ভাবছেন, বাঙ্গি জোলার মতো নিম্নবর্গের মুসলমান যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছেন। ধিকি-ধিকি তুষের আগুন বেড়ে উঠল। সাংবাদিক আলি আনোয়ার গড়ে তুললেন ‘পসমিন্দা মুসলিম মহাজ’ নামে পশ্চাৎপদ মুসলমানদের সংগঠন। এই সংগঠন তথাকথিত গোঁড়ামিকে বাদ দিয়ে অনুন্নত মুসলমানদের জন্য সরব হল।

এক দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পর বিহারে উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ, দলিত, কোন দল কত ভোট টানতে পারবে, সেই ছক কষা থামেনি। এই জাতপাতের অঙ্কটা যাঁরা উল্টে দিতে পারতেন— সেই বামপন্থীরা অন্তহীন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিজেদের পায়ের তলার জমি হারাতে হারাতে এখন প্রান্তবাসী। জাতপাতের অঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ বলে নিজেদের অহংবোধ বস্তার নীচে চাপা দিয়ে লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমার হাত মিলিয়েছেন, মুলায়ম সিংহ যাদবকেও কাছে টানতে চেয়েছেন। চিরকালের পাঁকাল মাছ মুলায়ম সিংহ কিন্তু পিছলে গিয়েছেন। এই ঘটনাকে লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমার প্রকাশ্যে গুরুত্ব না দিলেও, এটা ঠিক যে, মুলায়ম যেটুকু ভোট কাটবেন, তার গুরুত্ব এ বারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে কম নয়। বিজেপি বিরোধীরা বলছেন, মুলায়মের লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমারকে ছেড়ে যাওয়ার পিছনেও বিজেপি-র মাথা ছিল। লালু-নীতীশ জানেন, বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া মানুষের সমর্থনের জোরে জয়ের মুকুট পরা যাবে না, তাই তাঁরাও উচ্চবর্ণের ভোট টানতে মরিয়া। নীতীশ অতীতে উচ্চবর্ণের একটি অংশের সমর্থন পেয়েছিলেন, লালুপ্রসাদের প্রতিও রাজপুতদের একাংশ সমর্থন জানিয়েছিল। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের সমর্থন থাকাটা তাঁরা বাড়তি সুবিধা বলে মনে করছেন। ভোট-বাক্সে ধস নামলেও কংগ্রেসের প্রতি কিছু মানুষের দুর্বলতা এখনও রয়ে গিয়েছে।

বিহারের জাতপাতের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল পিছিয়ে ছিল বিজেপি। তাদের প্রতি উচ্চবর্ণের একটি অংশের এবং ব্যবসায়ীদের একটি অংশের সমর্থনের মধ্যেই তাদের ভোট-রাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল। পটনায় সি পি ঠাকুর বা গয়ায় ঈশ্বরী চৌধুরির মতো কয়েক জনের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ভোটের বাক্সে অনুকূল ফল দিত। কিন্তু সে সব ব্যতিক্রম। অবস্থা বুঝে বিজেপি নেতৃত্ব এ বার ভেবেচিন্তে গুছিয়ে ভোটের ময়দানে নেমেছে। অতীতে নীতীশ কুমারকে সমর্থন জানিয়েই তারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল। সেই সময়েই সব বর্ণের মানুষের মধ্যে সংগঠন প্রসারিত করার কাজে তারা হাত দিয়েছিল। তাতে দারুণ ভাবে সাহায্য করেছিল আরএসএস ও আর কয়েকটি সংগঠন। গত লোকসভার নির্বাচনে এই ‘কাজ’-এর সুফলও পাওয়া গিয়েছে। তার উপর এ বার রামবিলাস পাসোয়ান বিজেপি-র সঙ্গী। উচ্চাকাঙ্ক্ষী জিতনরাম মাঁঝিও নীতীশকে ছেড়ে আসতেই বিজেপি তাঁকে লুফে নিয়েছে। আরও কিছু ছোটখাটো গোষ্ঠী তাদের সঙ্গে। ওয়াইসির নেতৃত্বে এমআইএম-ও কিষাণগঞ্জ এলাকায় রয়েছে ভোট-ময়দানে মুসলিম ভোট কাটার খেলায়।

তবে কি জাতপাতের অঙ্ক-ই বিহারে ভোটের একমাত্র ফর্মুলা? সেটা বলা যাবে না। জাতপাত অন্যতম প্রধান বিবেচনা হলেও ভোটে শেষবেলায় কয়েক শতাংশ ভোটের এ দিক ও দিক হওয়া, যাকে বলে ‘সুইং’ ফ্যাক্টর, সেটার ভিত্তি হতেই পারে কিছু অতিরিক্ত বিবেচনা। যেমন নিম্নবর্ণের মানুষের পাশাপাশি উচ্চবর্ণের মানুষের বড় একটি অংশ নীতীশ কুমারকে সমর্থন জানিয়ে মসনদে বসিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নীতীশ কুমার কিছু ভাল কাজ করেছেন, আইন-শৃঙ্খলার অনেকটাই উন্নতি ঘটিয়েছেন। যে গণহত্যা বিহারে নিয়মিত ছিল, তা এখন নেই বললেই চলে। (ব্যতিক্রম, মাওবাদী হামলা।) তাঁর সেই ‘সাফল্য’ মূল্যহীন না-ই হতে পারে। তার সঙ্গে লালুপ্রসাদের ‘ক্যারিশমা’ তো আছেই। তাঁর প্রতিও রাজপুতদের একটি অংশ সমর্থন জানিয়েছিলেন। উল্টো দিকে রয়েছে বিজেপি-র কুশলী রাজনীতি, প্রতিশ্রুতির বন্যা। গত লোকসভা ভোটের সাফল্য এ বার বিজেপি-কে অনেকটাই আশাবাদী করে রেখেছে।

আজও বিহারের হাজার হাজার গরিব মানুষকে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যেতে হয়। আজও তাঁরা দারিদ্রতাড়িত মনে স্বপ্নের রঙিন বেলুনের পিছনে ছোটেন, তা সে জাতপাতের বেলুন হোক বা সোনার দিনের প্রতিশ্রুতির বেলুন-ই হোক। কোন বেলুন এ বার তাঁদের মন টানছে, কেবল জাতপাতের হিসেব দিয়েই সেটা ধরা অসম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE