Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

কে প্রতারক? কে-ই বা দেশদ্রোহী?

‘এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই, যদি না তোমার ক্ষমতা আর শক্তি থাকে।’ ২০১১ সালে কোনও কোনও প্রতিবাদী বন্ধুদের কণ্ঠেও ছিল এই উচ্চারণ। সেই ক্ষমতা আজ আমাদের কোথায় এনে ফেলেছে?৫ মে ১৯৪৫। নাৎসি বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত নেদারল্যান্ডস। অলিগলি থেকে রাজপথ সর্বত্র ছড়ানো-ছিটোনো রয়েছে মহাযুদ্ধের ধ্বংসচিহ্ন। তিন-তিনটে ক্যানাল দিয়ে ঘেরা আমস্টারডাম-এর শরীরে ভয়ানক সব ক্ষত। দেশে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ব্ল্যাক টিউলিপ’-এর পরিকল্পনা: প্রতিটি দেশদ্রোহী, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নাৎসিদের সহায়তা করেছিল কিংবা কোনও না কোনও ভাবে তাদের ঘনিষ্ঠ ছিল, সেই ‘দেশের শত্রু’দের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সীমানা পার করার কার্যক্রম রচনা।

কৌশিক সেন
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

৫ মে ১৯৪৫। নাৎসি বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত নেদারল্যান্ডস। অলিগলি থেকে রাজপথ সর্বত্র ছড়ানো-ছিটোনো রয়েছে মহাযুদ্ধের ধ্বংসচিহ্ন। তিন-তিনটে ক্যানাল দিয়ে ঘেরা আমস্টারডাম-এর শরীরে ভয়ানক সব ক্ষত। দেশে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ব্ল্যাক টিউলিপ’-এর পরিকল্পনা: প্রতিটি দেশদ্রোহী, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নাৎসিদের সহায়তা করেছিল কিংবা কোনও না কোনও ভাবে তাদের ঘনিষ্ঠ ছিল, সেই ‘দেশের শত্রু’দের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সীমানা পার করার কার্যক্রম রচনা। ডাচ পুলিশ ও ‘অ্যালায়েড আর্ট কমিশন’ তখন তদন্ত করছে, নাৎসিরা দেশের কোন কোন শিল্পসম্পদ অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই তদন্তে আবিষ্কৃত হয় যে নেদারল্যান্ডস-এর অন্যতম সেরা ধনকুবের আর্ট ডিলার হান ভ্যান মিগেরেঁ প্রচুর অর্থের বিনিময়ে প্রখ্যাত ডাচ শিল্পী ভেরমিয়ার-এর আঁকা ছবি কুখ্যাত নাৎসি সমরনায়ক গোয়েরিংকে বিক্রি করেছিলেন। ‘দেশদ্রোহী’ মিগেরেঁকে নিয়ে নারায়ণ সান্যালের কাহিনির নাট্যরূপ দিয়েছেন নাট্যকার কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। বহরমপুর রঙ্গাশ্রম নাট্যদল ‘প্রতারক’ নাটকটি সম্প্রতি মঞ্চস্থ করল কলকাতার এক মঞ্চে।

নির্দেশক সন্দীপ ভট্টাচার্যের কল্পনায় সমৃদ্ধ প্রযোজনাটি যে দিন দেখলাম, তার ক’দিন পরেই বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ। আমাদের জেগে উঠতে তো একটা না একটা বিস্ফোরণ লাগে। বিস্ফোরণ এই নাটকেও আছে। মিগেরেঁ যখন ডাচ পুলিশের কঠিন-কঠোর জেরার মুখে পড়ে দিশাহারা, তখন সেই গারদখানার নির্মম অন্ধকারের ভিতর ভেঙে পড়া সেই শিল্পী চিৎকার করে বলে ওঠে এক সময়, “যে ভেরমিয়ার-এর ছবি নিয়ে বিশ্ব তোলপাড়, ওই পুলিশ অফিসারের চোখে ঘুম নেই, ওগুলো নকল। আমি, আমি হান ভ্যান মিগেরেঁ, ভেরমিয়ার-এর ছবি আমি নকল করেছি, গোয়েরিংকে নকল ছবি দিয়ে ঠকিয়েছি আমি... আমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি....”

মিগেরেঁর জবানবন্দিতে হতবাক হয়ে যায় দুনিয়া। দু’পক্ষে বিভক্ত হয়ে যায়। এক পক্ষ বলে, নকল ছবি এঁকে গোয়েরিংকে প্রতারিত করা মিগেরেঁ হল্যান্ডবাসীর অহংবোধের অপর নাম। অন্য দিকে প্রশ্ন ওঠে যে, শিল্পী শুধুমাত্র অর্থলোভে দিনের পর দিন শিল্পপ্রেমী মানুষকে ঠকিয়ে বড়লোক হয়েছে, সে কী করে হতে পারে দেশপ্রেমিক? জার্মান ঘাতকবাহিনী যখন হল্যান্ডের সমস্ত সম্পদ লুঠ করছে, হত্যা করছে পুরুষ-নারী-শিশুদের, তখন ‘নকল’ ছবি বিক্রি করে মিগেরেঁ হয়ে উঠেছেন আমস্টারডামের অন্যতম ধনকুবের। এই মানুষটি আর যা-ই হোন, ‘শিল্পী’ নন। এক জন ‘প্রতারক’।

নাটক দেখতে দেখতে কতকগুলো কথা মনে এল। এ-নাটকের সঙ্গে হয়তো ঠিক মেলে না কথাগুলো, আবার হয়তো বা মেলেও কোনও এক অর্থে। আসলে মনে হচ্ছিল, সত্যিই, কে যে কী, কে যে কী নয়, কে যে কী হতে চেয়েছিলেন, কে যে কী হলেন, বোঝা বড় শক্ত হয়ে পড়ছে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা যেমন বলছে, ‘শব্দেরা গোলমাল করছে/ শব্দেরা চিৎকার করছে/ শব্দগুলি শব্দই থাকছে না আর মোটে।’

আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবিগুলি কত কোটিতে বিক্রি হয়েছে, তার পিছনে দুর্নীতি ছিল কি না, কারা কিনলেন সেই ছবি, স্বেচ্ছায় কিনলেন, না কি বাধ্য হলেন, এই সব কিছুর মীমাংসা করার জন্য সিবিআই তৎপর। কিন্তু এ সবের বাইরেও একটা প্রশ্ন মনে আসে, তার সঙ্গে আইনকানুনের সম্পর্ক নেই। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ‘শিল্পমনস্ক’, কবিতা লেখেন, ছড়া লেখেন, ছবি আঁকেন, আমরা এটুকু জেনে বা শুনে খুশি থাকতে পারি। কিন্তু তাঁর আঁকা ছবি প্রদর্শনী করে বিক্রি করা যেতে পারে— শিল্পগুলির শিল্পগত মূল্য কি ততটাই উচ্চ মানের?

ছবি বিক্রি করার জন্য কে তৎপর ছিলেন, কোন তৃণমূল নেতা, সে প্রশ্নের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, ওই ছবিগুলির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এমন দু’জন চিত্রকর, যাঁদের খ্যাতি দেশের সীমানা পার হয়ে পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। মানুষের কাছে শিল্পী মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি তৈরিতে বড় ভূমিকা ছিল তাঁদের। ঘটনাচক্রে তাঁদের এক জন সিবিআই ও ইডি’র তদন্তের মুখোমুখি। অন্য জন তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভায়। এই সবই বার বার মনে পড়ছিল ‘প্রতারক’ দেখতে দেখতে।

খবরের আধিক্যে উপচে পড়ছে সংবাদপত্রের পাতা, নতুন চেহারায় তৈরি হচ্ছে ‘ফুটেজ’, শিরোনামে ভরে উঠছে আমাদের সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা। প্রতিদিন বাড়ছে, বেড়ে চলেছে আমাদের কৌতূহল: এ বার কে? কোন শিল্পী, কোন শিল্পপতি, কোন সাংবাদিক, কোন ক্লাবকর্তা বা কোন মন্ত্রী? কে প্রতারক? খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর তো প্রশ্নটা আরও তীক্ষ্ণ: কে দেশদ্রোহী?

সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত সম্ভবত জনসভা করতে আসবেন পশ্চিমবঙ্গে। স্বভাবতই, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সেই উপলক্ষে জোরদার করবেন হিন্দুত্বের প্রচার। উদার, জাতীয়তাবাদী জিগিরের আপাতস্বচ্ছ স্লোগানের মাঝেই থাকবে সংখ্যালঘু মানুষদের কোণঠাসা ও সন্ত্রস্ত করে তোলার প্রয়াস। সন্ত্রাসের বিরোধিতার কর্মসূচির ভিতরেই লুকিয়ে থাকবে বাঙালির মনের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ঘৃণার সর্পটিকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস। নেতা-নেত্রীদের অপরিসীম ব্যর্থতা ও মাত্রাছাড়া লোভ সেই পথকে প্রতিদিন সুগম করছে। কবির রচিত শব্দ কখনও কখনও এতটাই অমোঘ হয়ে ওঠে যে চমকে উঠতে হয়: ‘...এড়াবার জন্য আমি/ দৌড়োতে দৌড়োতে/ কোনও এক জঙ্গলের প্রান্তে যেতে চাই।/ কিন্তু জঙ্গল কোথায় পাব?/ তারও আজ পালটে গেছে মানে/ এপারে ওপারে দেখি সবাই দুর্বাসা।’

প্রতিদিন সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে যত বার ভেসে উঠছে মাদ্রাসা, জেহাদ, জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ, রাজিয়া, আলিমা, শাকিল, হাশেম... তত বারই ভয় হচ্ছে, এই নামগুলোর মাধ্যমে একটা বৃত্তর জনগোষ্ঠীকে জড়িয়ে ফেলার সহজ অথচ ভয়ংকর চক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গে মাথা তুলবে না তো? আর সব কিছুর মতোই রাজনীতিতেও একটা ভারসাম্য থাকে। অপদার্থ রাজ্য সরকারের তৈরি করা নানান ফাঁকফোকরে, কমিউনিস্ট পার্টির ও কংগ্রেসের অতীব দুর্বল উপস্থিতিতে নতুন শক্তি ভারতীয় জনতা পার্টি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সামনে সুনিশ্চিত ভাবে নিজেদের খাড়া করার চেষ্টা করছে প্রবল শক্তি নিয়ে। ক্ষমতার পরিসর কখনও ফাঁকা থাকে না, কোনও না কোনও ভাবে তা পূর্ণ হয়ে যায়। ইতিহাস তার নিজস্ব নিয়মেই এগিয়ে চলবে, তাকে ঠেকানো বড় মুশকিল। কিন্তু যত শক্তিমানই হোক না কেন সময়, একমাত্র মানুষই তো পারে তাকে প্রশ্ন করতে। যাচাই করতে। মানুষ চাইলে বলতে পারে, ‘তুমি যতই আমায় স্রোতে ভাসিয়ে নিতে চাও, তবু আমি পাল্টা প্রতিরোধ করব, প্রশ্ন করব, নতুন ভাবে ব্যাখ্যা চাইব তোমার কাছে’।

বামফ্রন্ট আমলের পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মানুষের ভিতর ছিল ‘পরিবর্তন’-এর আকাঙ্ক্ষা। এই বদলের অন্যতম শরিক বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট মানুষদেরও ছিল সেই স্বপ্ন। তবু কেমন ভাবে আমাদের মধ্যে ঘটল বিচ্ছেদ, একটা বড় অংশে কেমন ভাবে ঢুকল চুপ করে যাওয়ার প্রবণতা বা ক্ষমতার প্রসাদ ভাগ করে নেওয়ার হুড়োহুড়ি। আবারও আসবে, আসতে চলেছে, পথে নামার আহ্বান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্রসমাজের একটা বড় অংশ সেই সম্ভাবনাকে আরও উসকে দিয়েছে। এই আন্দোলন স্বাভাবিক কারণেই একটা সময়ে এসে থমকে দঁড়াতে বাধ্য হবে, কারণ ছাত্রছাত্রীরা কোনও ভাবেই কোনও রকম দলীয় রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি, কোনও ফসল তুলতে দেননি। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার পাশাপাশি সিপিআই (এম), কংগ্রেস এবং যে পার্টিকে ঘিরে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছেন বহু মানুষ, সেই বিজেপি’র ক্ষেত্রেও একই রকম দূরত্ব বজায় রেখেছেন তাঁরা।

এবং এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও আমাদের রাজ্যের মাননীয় রাজ্যপাল তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের ওপর পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া সেই উপাচার্যকে স্থায়ী পদ দিয়েছেন। প্রহরা বসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায়। ক্ষমতা যেমন পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংস্র ভাবে লড়াই করে, তেমনই সময় বুঝে একে অপরের সঙ্গে সমঝোতাও করে। কারণ, দখল করা তার অভ্যাস। তার গ্রাস থেকে দেশ রাজ্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চিত্রশালা নাট্যশালা, কেউ বাদ পড়ে না। সেই দখলে বাধা পড়লে তাদের চেহারা একই রকম।

ভেরমিয়ার-এর চিত্রকলা নকল করা মিগেরেঁর জীবনে নানান অপ্রাপ্তি ছিল, অবশ্যই ছিল ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা। সেই ব্যর্থতার জ্বালা তাকে করেছিল ‘প্রতারক’, সে মনে করেছিল যে, ‘এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই, যদি না তোমার ক্ষমতা আর শক্তি থাকে।’ শুনতে শুনতে প্রেক্ষাগৃহে বসে চমকে উঠেছিলাম, কারণ ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আমার কোনও কোনও প্রতিবাদী বন্ধুদের কণ্ঠেও ছিল একই রকমের বিশ্বাসের উচ্চারণ। তাঁরা সন্দেহাতীত ভাবে প্রতিভাবান, নিশ্চিত রূপেই ক্ষমতাসম্পন্ন এবং অনিবার্য ভাবেই দুঃখী। তার কারণ, তাঁরা ‘প্রতারণা’ করেছেন নিজেদের সঙ্গেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kaushik sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE