Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ

কাশ্মীরের মধ্যপন্থীরা ক্রমশ আরও একা

হাইপার-জাতীয়তাবাদ যেমন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত নয়, তেমনই কাশ্মীরি সংবাদমাধ্যমে বিচ্ছিন্নতার অতিপ্রচারও ভাল নয়। সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি ভাল নয়, জঙ্গি তৎপরতাও ভাল নয়। শ্রীনগরে গিয়ে এটাই মনে হল।আপ তো হিন্দুস্তানি জার্নালিস্ট হ্যায়। হম ‘কাশ্মীরি মিডিয়া’। শ্রীনগরে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি এক আলোচনাসভার আয়োজন হয়েছিল। দু’দিন ধরে বার বার সেখানে কাশ্মীরি সাংবাদিকদের মুখে এ কথা শুনতে শুনতে শেষে আর চুপ থাকতে পারলাম না, বলেই ফেললাম, ‘আমি তো নিজেকে ভারতীয় সাংবাদিক বলেই জানতাম।

কোনও একটি বন্ধ-এর দিনে। জম্মু ও কাশ্মীর, ২০১৫। ছবি: পিটিআই।

কোনও একটি বন্ধ-এর দিনে। জম্মু ও কাশ্মীর, ২০১৫। ছবি: পিটিআই।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আপ তো হিন্দুস্তানি জার্নালিস্ট হ্যায়। হম ‘কাশ্মীরি মিডিয়া’। শ্রীনগরে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি এক আলোচনাসভার আয়োজন হয়েছিল। দু’দিন ধরে বার বার সেখানে কাশ্মীরি সাংবাদিকদের মুখে এ কথা শুনতে শুনতে শেষে আর চুপ থাকতে পারলাম না, বলেই ফেললাম, ‘আমি তো নিজেকে ভারতীয় সাংবাদিক বলেই জানতাম। তা আপনি এবং আপনারা কাশ্মীরি মিডিয়া কি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নয়? আমি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সংবাদপত্রের সাংবাদিক, আটাশ বছর ধরে দিল্লিতে কর্মরত। আমি কি তা হলে পশ্চিমবঙ্গীয় সাংবাদিক, না ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট!’ উপত্যকার সাংবাদিকরা সমবেত ভাবে বলে উঠেছিলেন, ‘আমরা কাশ্মীরি দাদা, হিন্দুস্তানি নই।’

অনেক দিন পর শ্রীনগর গেলাম। সংবাদমাধ্যম সম্পর্কিত আলোচনায় যোগ দিতে আমার মতো গদ্যকর্মীরা গিয়েছিলেন, ছিলেন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাংবাদিকরাও। ছিলেন দূরদর্শনের উপদেষ্টাও। এবং উপত্যকার সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও। মূল উদ্দেশ্য ছিল দু’দিন ধরে আলোচনার মাধ্যমে এক সেতু রচনার চেষ্টা করা। অথচ এই দু’দিনে স্পষ্ট বোঝা গেল নয়াদিল্লি থেকে কাশ্মীর এখনও কত আলোকবর্ষ দূরে! যে সংবাদমাধ্যম জনমতকে প্রভাবিত করে, তারাই কিনা ঘোরতর বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার! এবং, এই বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে কোনও গ্লানিও নেই! কুণ্ঠাও নেই! খাস শ্রীনগরে সাংবাদিকরাই যদি এমন ভাবেন, উপত্যকার প্রত্যন্ত গ্রামে বিচ্ছিন্নতার শিকড় কত দূর বিস্তৃত হতে পারে!

সত্তর বছর ধরে এই বিচ্ছিন্নতাবোধকে প্রশ্রয় দিয়ে কাশ্মীরের কোন উপকারটা হয়েছে? বিহারে গেলে রাস্তার যে অবস্থা দেখি এখানেও তো সেটাই দেখছি। দু’টোই তো ভারতের রাস্তা। বঞ্চনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন তুললেও বলব, এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বাঙালিরও অনেক বঞ্চনার অভিযোগ রয়েছে, যেমন আছে অন্য নানা প্রদেশের মানুষের। মানছি, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতার প্রেক্ষাপট পৃথক। মানছি, অতীতের পৃষ্ঠায় থাকা শেখ আবদুল্লা ও হরি সিংহ, মাউন্টব্যাটেন-গাঁধী, নেহরু-জিন্নার ভূমিকা নিয়ে আজও এ প্রান্তে বিতর্ক সজীব। স্থানীয় প্রকাশক ও বইয়ের দোকানে গেলে তা বোঝা যায়। এ ব্যাপারে নতুন নতুন বই প্রকাশিত হয়েই চলেছে। কিন্তু তফাত কি শুধু সেখানেই? বিচ্ছিন্নতাবোধের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণগুলোকে যে ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাও কি কম গুরুতর? বহু হুরিয়ত নেতাদের কথাই যদি ধরি, তাঁরাও ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যস্ত। কেউ স্থানীয় বাজারের ইজারা নিয়েছেন। কারও আমদানি-রফতানির ব্যবসা। অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত। কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাই তাঁদের রাজনীতির মূলধন।

দু’দিনের আলোচনা যখন চলছে, দেখি স্থানীয় সংবাদপত্রে একটি কার্টুন প্রকাশিত হল। এক রোবট কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যমের মঞ্চে সেমিনার করতে এসেছে। পিছন থেকে হাতে রিমোট নিয়ে দিল্লি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আলোচনাসভায় ‘হিন্দুস্তানি’ সংবাদমাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীরা ভারতীয় রাষ্ট্রের সমালোচনা করতে শুরু করে দিলেন। শুনতে শুনতে মনে হল, আমিই কি তবে ভারতীয় রাষ্ট্র! ওঁদের বললাম ভারতীয় সেনাবাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে আমরাও কিন্তু তার তীব্র সমালোচনা করি। আমরা ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছি না। আমরা স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি। সংবাদমাধ্যমের যে সব ত্রুটিবিচ্যুতি, তা যেমন দিল্লিতে আছে, তেমনই কাশ্মীরেও আছে। হাইপার-জাতীয়তাবাদ যেমন ভারতীয় চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত নয়, তেমনই কাশ্মীরি সংবাদমাধ্যমে বিচ্ছিন্নতার অতিপ্রচারও ভাল নয়। সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়িও ভাল নয়, আবার তা বলে জঙ্গি তৎপরতাও ভাল নয়। মডারেট বা মাঝামাঝি পথে চলা মানুষেরা এ সমাজে ক্রমশ বেশি বেশি করে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু সে কথা কাশ্মীরের মানুষের কাছে কতটা পৌঁছল? আদৌ কি পৌঁছল? পৌঁছবে? পৌঁছে দেওয়া হবে? এমনিতেই বেজায় খারাপ অবস্থা ভূস্বর্গের। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত বিশ বছরে এ হেন বর্ষণ কখনও হয়নি। ঝিলম নদীর জলস্রোত রুখতে এক পৃথক কৃত্রিম খাল তৈরি হয়েছিল জল নিকাশের জন্য। তবুও বিপর্যয়কে রোখা যায়নি। ভেসে গিয়েছে কাশ্মীর। নিশ্চিহ্ন কত বাড়ি, কত দোকান। ওমর আবদুল্লার বাড়ির মধ্যেও জল জমেছিল সাত দিন। যদিও, যথারীতি, অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষই।

এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে কাশ্মীর রাজনীতিও এক বড় সংকটের মুখোমুখি। মুফতি মহম্মদ সৈয়দ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন সবে তিন মাস হল। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারছেন বিজেপির মতো এক জাতীয় হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ফল কী হতে পারে। এই জোটের ফলে রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়ছে বই কমছে না। কারণ বিজেপিকে অন্তর থেকে শ্রীনগরের মুসলমান সমাজ কিছুতেই গ্রহণ করতে পারে না। স্থানীয় নাগরিক সমাজ, মুসলিম বিদ্বজ্জনেদের মনে হচ্ছে, যে বিজেপি ‘হিন্দুস্থানি’ সরকার চালাচ্ছে, তারা এখানে সঙ্ঘ পরিবারের কৌশলে জম্মু ও কাশ্মীরের বিভাজন বাড়াচ্ছে। নিরাপত্তার অভাববোধের এই বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে বাড়ছে জঙ্গি কার্যকলাপ। বাড়ছে প্রবীণ গিলানির জনপ্রিয়তা। ফলে কাশ্মীর সরকার এখন তাঁকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। অল্পবয়সী ছেলেরা আবার জঙ্গি সংগঠনে নাম লেখাচ্ছে। বিশেষত দক্ষিণ কাশ্মীরে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ দিকে দারিদ্র চরমে। বেকারি। অপুষ্টি। তবু উন্নয়ন এখনও কাশ্মীরের প্রধান আলোচ্যসূচি নয়। নরেন্দ্র মোদী যদি উন্নয়নের কথা বলেন তা হলেও কাশ্মীরি জনমানস মনে করে, হিন্দুস্থানি সরকার কাশ্মীরি আজাদির চেতনাকে ভোলানোর চেষ্টা করছে।

কাশ্মীর মানে আজও আমাদের কাছে পর্যটনের জায়গা। অমরনাথ যাত্রা সফল হল, না কি জঙ্গি নাশকতায় তা বন্ধ করতে হল, এটাই যেন কাশ্মীর সরকারের সাফল্যের একটি বড় পরীক্ষা। বাঙালি, গুজরাতি ও দক্ষিণী পর্যটকদের প্রিয় স্থান এই শ্রীনগর। এখানে এসে পর্যটকেরা ডাল লেকে থাকেন। শিকারায় অনেকে রাত্রিবাস করেন। মুঘল বাগানে নানান রঙিন ফুলের বাহার দেখে মুগ্ধ হন। সেই মুগ্ধতাকে বিক্রি করে শ্রীনগরের কিছু যুবক, কিছু ব্যবসায়ী দৈনন্দিন অন্নচিন্তা সামাল দেন। কিন্তু বার বার এসেও কাশ্মীরের আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থা অতীতে যা দেখেছি, আজও তাতে বড় কোনও পরিবর্তন দেখছি না। সাংবাদিক হিসাবে তিন দশক আগে যখন এসেছিলাম, তার সঙ্গে আজ ফারাক কোথায়! এর মধ্যে প্রায় পঁচিশ বার এসেছি এই প্রান্তে। চারার-এ-শরিফ-এ যখন আগুন লাগে, হজরতবালে জঙ্গিরা প্রবেশ করে, বার বার ভোট হয়— যখনই এসেছি, কখনও ফারুক, কখনই মুফতি, কখনও গুলাম নবি। এখানেও রাজার পোশাক বদলায়, রাজতন্ত্র বদলায় না। ৩৭০-এর অধিকারে কোটি কোটি টাকা আসে। সে টাকা প্রত্যন্ত কাশ্মীরের গরিব মানুষ পর্যন্ত পৌঁছয় না।

শ্রীনগর থেকে দিল্লি ফেরার পথে সহযাত্রী ছিলেন এক অবসরপ্রাপ্ত কাশ্মীরি বিচারক। প্রবীণ মানুষটিকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘সবার মুখে শুনে এলাম জঙ্গি তৎপরতা আবার বাড়ছে।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘ও তো এখানে কখনও বাড়ে, কখনও কমে। যখন কমে তখনও আসলে কমে না। আবার যখন বাড়ে তখনও এতটা বাড়ে না যে আর কমবে না। আসলে যে সরকারই আসুক তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ে। কারণ কাশ্মীরের মানুষের সমস্যার সমাধান হয় না। কাশ্মীর সমস্যার নাম করে রাজনীতিকরা দারিদ্র, বেকারির মতো সমস্যাকে ভুলিয়ে রাখেন। গৃহবন্দি গিলানি ভোট বয়কট করেন তাই জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁকে যদি মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়া হয় তা হলে তিনিও অচিরেই জনপ্রিয়তা হারাবেন। এটাই দস্তুর। আপনাদের হিন্দুস্তানে মোদী থেকে মমতা, সকলকেই এই অসন্তোষের মোকাবিলা করতে হয়। এই জন্যই দিল্লির মনমোহন সিংহ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সকলকেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে।’

কিন্তু কাশ্মীরকে তাদের সঙ্গে মেলানো যাবে না। এ রাজ্যের রাজনীতি মানে এক বিচিত্র ত্রিভুজ। ত্রিভুজের প্রথম বিন্দু: দিল্লি-শ্রীনগর সম্পর্ক। দ্বিতীয় বিন্দু: জম্মু-কাশ্মীর অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক। আর তৃতীয় বিন্দু: ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। একটা প্রশ্নের সমাধান করতে গেলে অন্য বিন্দুগুলিতেও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সহযাত্রী প্রবীণ বিচারকের সখেদ মন্তব্য, ‘এখন তাই আমরা খবরের পিছনে দৌড়ই না, প্রতিদিন টিভি চ্যানেলের খবর আমাদের তাড়া করে ফেরে। আমরা খবর পড়ি। খবর শুনি। সব দেখি। সব বুঝি। কোনও উত্তর নেই কারও কাছে।’ দিল্লি বিমানবন্দরে কনভেয়ার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলে এলাম, ‘সমাধান হয়তো দিতে পারব না, কিন্তু আপনার হতাশার কথা, খেদের কথা আমার পাঠককে জানাতে তো পারি।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE