Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ক্ষমতা বদলায়, সমাজ বদলায় না

ক্ষমতার দিকে সুবিধেবাদীদের পাল্লা সব সময় ভারী থাকবে এই ট্র্যাডিশনই সমানে চললে সমাজ ঠিক দিকে এগোবে না। লিখছেন অশোককুমার মুখোপাধ্যায়।কলকাতা শহরের একটি খণ্ডচিত্র। সংসদীয় নির্বাচনের কিছু আগে আলিপুর-রাসবিহারীর এক অটোচালককে বলতে শুনেছিলাম, ‘সিপিএমকে ভোট দিয়েছিলাম, কিছু হল না; তৃণমূলকে দিলাম, কিছুই হচ্ছে না; এ বার আমরা সবাই ঠিক করেছি বিজেপি’কে দেব।’

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

কলকাতা শহরের একটি খণ্ডচিত্র। সংসদীয় নির্বাচনের কিছু আগে আলিপুর-রাসবিহারীর এক অটোচালককে বলতে শুনেছিলাম, ‘সিপিএমকে ভোট দিয়েছিলাম, কিছু হল না; তৃণমূলকে দিলাম, কিছুই হচ্ছে না; এ বার আমরা সবাই ঠিক করেছি বিজেপি’কে দেব।’ এ কথার প্রতিধ্বনি শোভাবাজার-উল্টোডাঙা সহ শহরের অন্যান্য কিছু রুটে শুনেছি একাধিক বার। এই অটোচালকদের অধিকাংশেরই শোনা যায়, লাইসেন্স নেই, ব্যবহার যাত্রীরাই জানেন, অতীব বেয়াড়া।

হলুদ-যানের ড্রাইভাররা এই মুহূর্তে খুবই তপ্ত। কারণ, পুলিশের ‘বাড়াবাড়ি’। পুলিশ নাকি কথায়-কথায় ফাইন নিচ্ছে। কারণ, ওদের নাকি ফাইন নেওয়ার মাসিক টার্গেট আছে এবং সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পুলিশ এখন শ্যেনচক্ষু! গাড়িতে কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকা, তাপ্পিমারা চাকা ব্যবহার, বেল্ট না পরে গাড়ি চালানো এবং লালবাতি না মেনে এগিয়ে যাওয়া মোটামুটি এই চার কারণে পুলিশ ধরে। কড়াকড়ি বেশি, এমন মোড় পেরিয়ে যাওয়ার সময় এক ড্রাইভারকে ঠাকুরের নাম জপতেও দেখেছি, নির্বিঘ্নে মোড় পেরিয়ে তিনি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন! এক ট্যাক্সিচালক তো এই কড়াকড়ির কারণে বর্ধমান রোড ডায়মন্ড হারবার রোডের সংযোগস্থলে যেতেই চাইলেন না!

হয়তো কিছু ‘বাড়াবাড়ি’ করছে পুলিশ, কিন্তু শতাংশের বিচারে তা নগণ্য। এবং এটা তো মানতেই হয়, এর ফলে বেপরোয়া ট্যাক্সি-অটোচালক কিছুটা হলেও সংযত হয়েছেন। আবার একই সঙ্গে পরিবহণমন্ত্রী তথা বর্তমান রাজ্য সরকারের ওপর ক্ষোভও জন্মেছে তাঁদের। আজ ‘পুলিশি অত্যাচার’-এর কারণে এঁরা যদি সিপিএম-কংগ্রেস কিংবা বিজেপিতে যোগ দেন, তারা কি তাদের ধ্বজা তুলে দেবে না এই অতিথিদের হাতে?

অতীতে, কংগ্রেসের মস্তান-গুন্ডা সম্প্রদায় যখন পুলিশের একাংশের সহযোগে নকশাল-নিধনে তত্‌পর, কংগ্রেস এবং সিপিএম, দুই পরস্পরবিরোধী স্তম্ভই তাদের স্বাগত জানিয়েছে। কেউই বলেনি যে, খতম-লাইনের প্রবক্তা নকশালরা রাষ্ট্রের চালু আইনে অপরাধী, কিন্তু তাদের শাস্তি দেবে প্রশাসন, কিছু লুম্পেন নয়। কংগ্রেস জমানা শেষের সময়ে এই লুম্পেনকুল আবার সিপিএম কর্মীদেরও ছাড়েনি। কিন্তু ভোটে জিতে বামফ্রন্ট এলে পুরনো চেনা গুন্ডা, জায়মান মস্তানরা সব ভিড়ে গেছে সিপিএমে। তিন দশকের রাজত্বকালে মস্তিষ্কহীন মস্তান তৈরিও করেছে তারা। ওরা ভোট কন্ট্রোল করবে। নামী নেতা শালীনতার সীমানা ছাড়ালেও, আলিমুদ্দিনের নেতারা চক্ষু মুদে উটপাখি। কারণ, নেতার আস্তিনে গোটানো ভোটের সংখ্যা। আবার এদের তিন দশকের মস্তানির জেরেই হেরেছে লালপার্টি। চেনা অঙ্ক মেলেনি। আর তখনই এই পরজীবী মস্তান সম্প্রদায় এবং কল্কে-না-পাওয়া সুবিধাভোগীরা সদলবল ছুটেছে তৃণমূলে। এবং এই পার্টির মাথারা সোত্‌সাহে স্বাগত জানিয়েছেন তাদের। হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ঘাসফুল পতাকা।

আজ এ কথাও স্পষ্ট, ভোটের অঙ্ক বাড়াবার কৌশলী তত্ত্বে সাংসদ নির্বাচনে তৃণমূল নেত্রী যেমন উচ্চগ্রামে বিজেপি বিরোধিতা করেছিলেন, সিপিএম প্রায় ততটাই উঁচু গলায় তৃণমূলকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তাদেরই বিশেষিত ‘সাম্প্রদায়িক’ মোদী-বিজেপির বিরুদ্ধে, পশ্চিমবঙ্গের যে-কোনও রাজনীতিসচেতন মানুষ জানেন, লালপার্টি তখন তুলনামূলক ভাবে নরম। কেন? না, তাদের হিসাব মতো তৃণমূল-বিজেপির লড়াই হবে। ফাঁকতালে জিতবে সিপিএম। বাস্তবের ফল হল উল্টো। দেখা গেল, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী-সমর্থকরাই বিজেপির সংখ্যা বাড়িয়েছে। সে অন্য কথা। কিন্তু সে দিন ভোটের প্রচারে সংখ্যার কথা ভেবেই তো তাদের নীতি বিসর্জন দিয়ে বিজেপি প্রসঙ্গে নমনীয়তা!

এ সময়ে সব থেকে অপদার্থ, সুবিধাবাদী ভূমিকা আলোকিত বিদ্দ্বজ্জনদের (কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণ দিয়ে এই গোষ্ঠীর ন্যক্কারজনক ভূমিকা বিচার করা যায় না)। এঁরা অনেকেই সব কিছু জেনেবুঝেও কেউ সিনেমায় ব্যস্ত, রিহার্সালে মগ্ন, ‘ঘটনা পুরোটা জেনে বিচার করতে হবে’, ‘কয়েক দিন খবরের কাগজ-টিভি দেখা হয়নি’ বলে পালাতে চাইছেন। কেউ আবার মুখ ঢেকেছেন শিশুপাঠ্য কাহিনিতে অথবা বার্ষিক-রচনা উত্‌পাদনে। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে যাঁদের একটা বড় দায় থাকে সুস্থ মত লালন করবার, তাঁরা অর্থপূর্ণ ভাবে মৌনী। আগামী দিনে, রাজ্যের রংবদলে এঁদের কোনও ক্ষতি হবে না। পার্টির ধারক-বাহক তলানিরা পীড়িত-দলিত-নিহত হতে থাকবে, শাস্তি পাবে, কিন্তু মধুলোভীরা সুবিধা মতো দল পাল্টাবেন।

আবার এক খণ্ডচিত্র। সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা-ছ’টা। এলিয়ট রোড-মল্লিকবাজার হয়ে পার্কসার্কাসগামী এক অটোচালক তাঁর যানটিকে এক বড় সাদা গাড়ির দরজা ঘেঁষে, দরজায় আঁচড় কেটে অদূরেই লালবাতি ক্রসিংয়ে দাঁড় করালেন। সাদা গাড়ি থেকে নামল তিন জন। তিন জনের মুখেই পানমশলা। অটোচালকদের সামনে গিয়ে জবাবদিহি চাইল। যাঁরা ওই অঞ্চলে এক বারও অটোয় চড়েছেন, জানবেনই কত কর্কশ চালকের দল। তো সেই চালকও যথানিয়মে রুখে উঠলেন। লঙ্কাকাণ্ড লাগতে যায় আর কী। হঠাত্‌ ওই তিন মাথার এক জন বলল, ‘জমানা পাল্টে গেছে, ‘...’ রেখে দেব।’ এবং কী আশ্চর্য! সেই কুড়ি-বাইশের অটোচালক মুখ গোঁজ করে নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন। জমানা পাল্টাবার অর্থ তিনি বোঝেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial ashoke kumar mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE