Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

গণতন্ত্রের উপহার

সারদা মামলায় আপাতত কেবল তদন্ত চলিতেছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী দৃশ্যত অসমাপ্ত তদন্তের অভিঘাতেই উত্তরোত্তর বেসামাল। তাঁহার ভাষায় এবং ভঙ্গিতে যে অব্যবস্থিতচিত্ততার উৎকট নিদর্শন, তাহাতে একটি আতঙ্কিত অন্তরাত্মার ছায়া স্পষ্ট। তাঁহার আতঙ্কের যথেষ্ট কারণ আছে। ঘটনা ইহাই যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার শাসনের নৈতিক অধিকার হারাইয়া ফেলিয়াছেন।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

সারদা মামলায় আপাতত কেবল তদন্ত চলিতেছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী দৃশ্যত অসমাপ্ত তদন্তের অভিঘাতেই উত্তরোত্তর বেসামাল। তাঁহার ভাষায় এবং ভঙ্গিতে যে অব্যবস্থিতচিত্ততার উৎকট নিদর্শন, তাহাতে একটি আতঙ্কিত অন্তরাত্মার ছায়া স্পষ্ট। তাঁহার আতঙ্কের যথেষ্ট কারণ আছে। ঘটনা ইহাই যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার শাসনের নৈতিক অধিকার হারাইয়া ফেলিয়াছেন। সেই অধিকার বিধানসভার আসনসংখ্যা বা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে নীতিনিষ্ঠ ভাবে রাজধর্ম পালনের উপর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আপন শাসনের মধ্যপর্বে সেই নৈতিক অধিকার হারাইয়াছিলেন, তখনও তাঁহাদের হাতে ২৩৫টি আসন ছিল, পাটিগণিত রাজধর্মের ঘাটতি পূরণ করিতে পারে নাই। ইতিহাসে এমন নজির কম নাই। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বা বফর্স কেলেঙ্কারিতে রাজীব গাঁধীর স্বর্গ হইতে বিদায় নিশ্চিত হয়, আইনি বা নির্বাচনী পরাজয়ের অনেক আগে উভয়েরই নৈতিক পতন ঘটিয়া গিয়াছিল। বস্তুত, রাজীব গাঁধীর ব্যক্তিগত দুর্নীতি প্রমাণিতই হয় নাই, কিন্তু জনচক্ষে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর জন্য আদালতের দণ্ডাদেশের অপেক্ষা করিতে হয় না। সারদা কেলেঙ্কারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা হরণ করিয়া লইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর লজ্জাকর এবং ন্যক্কারজনক আচরণ তাহারই পরিণাম।

আপাতদৃষ্টিতে, অপরিণত বুদ্ধিই মুখ্যমন্ত্রীর সমস্যার কারণ। তদন্তের প্রক্রিয়াটিকে নিজের মতো চলিতে দিয়া ‘আইন আইনের পথে চলিবে’ বলিয়া থামিলেই তো বিচক্ষণতার কাজ হইত, আগ বাড়াইয়া কে চোর, কে চোর নহে, কে কোথায় বসিয়া কোন ষড়যন্ত্র করিতেছে, সেই সকল কথামৃত প্রচারের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। পরিণত বুদ্ধি যে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পদ নহে, তাহা সংশয়াতীত, কিন্তু তাহা গৌণ ব্যাপার। মূল সমস্যা মূলেই। তাঁহার চার পাশে, বিভিন্ন বলয়ে যাঁহারা বিরাজমান, তাঁহাদের এক বিরাট অংশ যে ভাবে দুর্নীতির অভিযোগে জড়াইতেছেন, তাহাতে এই ধারণা স্বাভাবিক যে, মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে রাজধর্ম পালন সম্ভবই নহে, আপাদমস্তক পাঁকে ডুবিয়া থাকিলে প্রশাসনকে প্রশাসনের কাজ করিতে দেওয়া যায় না, তাহাকেও ক্রমাগত পাঁকে নামাইতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন দুর্নিবার বেগে পঙ্কিল অতলে নামিতেছে।

নামিতেছে পশ্চিমবঙ্গ নামক দুর্ভাগা রাজ্যটিও। অধোগতি তাহার জীবনে নূতন নহে। ষাটের দশক হইতেই তাহার অবনমনের শুরু। বামপন্থীরা প্রথমে বিরোধী হিসাবে এবং তাহার পরে শাসকের ভূমিকায় সেই উল্টোরথের সারথি হইয়াছিলেন। প্রশাসনকে রাজধর্ম হইতে দলধর্মের দাসে পরিণত করিবার কাজটি তাঁহারাই সম্পন্ন করিয়াছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ধর্মচ্যুতির উত্তরাধিকারটিকে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে অতলান্ত অধর্মে রূপান্তরিত করিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গে আলো বহু দিনই ছিল না, কিন্তু এমন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার এবং সম্পূর্ণ হতাশা এই রাজ্যের পক্ষেও ঈষৎ অতিরিক্ত ঠেকিতেছে। এই পরিণতির জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আপনাকে দায়ী করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও উপায় নাই। তাঁহাদেরই ভাবিতে হইবে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে তাঁহারা কেন, কী ভাবে নিজেদের আজ এই নরকে আনিয়া ফেলিয়াছেন। বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছর বঙ্গীয় রাজনীতির জমিতে গণতন্ত্রেরই ফসল ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পশ্চিমবঙ্গবাসী দ্বারা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে প্রদত্ত গণতন্ত্রের উপহার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE