Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

গোদা কথাই ট্রাম্প কার্ড

হ্যাঁ, বলেছি, এত শীত পড়েছে, তা হলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে কোথায়? আমাকে অনেকে ক্লাউন বলছে। কিন্তু আমিই আমজনতার আত্মা।কী  দিয়েছি! আবার হইহই পড়ে গেছে! ফি হপ্তায় বাঘা কোটেশন আর তাৎক্ষণিক কাঁইকাঁই, হ্যাহ্যা আর ছ্যাছ্যা’র এই টিআরপি-বাচক মোক্ষম কম্বো, যে-সে পারে বাওয়া? যবে থেকে ইলেকশনের রেসে ঢুকেছি, সুপারহিট রিয়েলিটি শো-র চরকি লাগিয়ে রেখেছি গোটা আমেরিকায়।

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:১৮
Share: Save:

কী  দিয়েছি! আবার হইহই পড়ে গেছে! ফি হপ্তায় বাঘা কোটেশন আর তাৎক্ষণিক কাঁইকাঁই, হ্যাহ্যা আর ছ্যাছ্যা’র এই টিআরপি-বাচক মোক্ষম কম্বো, যে-সে পারে বাওয়া? যবে থেকে ইলেকশনের রেসে ঢুকেছি, সুপারহিট রিয়েলিটি শো-র চরকি লাগিয়ে রেখেছি গোটা আমেরিকায়। আর কে না জানে, আমেরিকায় যা খবর, বিশ্বে তাহাই মূল চাটনি? প্যারিসের ঘোটালাটা হওয়ার পর থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম। এ বার বলে দিলাম, মুসলিমদের আলাদা আই-ডি’র ব্যবস্থা করা ভাল। সঙ্গে এও জুড়েছি: মসজিদগুলোর ওপর কড়া নজর রাখতে হবে, ওখানে হাবিজাবি কাজ হয়, কয়েকটা মসজিদ বন্ধও করে দিতে হবে। হাহা! যদ্দিন এই নানা জাতের লোকগুলো আমাদের রাস্তা কিলবিল করছে, তদ্দিন আমার স্পিচ লেখার সময় তুবড়ির কমতি পড়বে না। টিভিতে-কাগজে আঁতেলগুলো এমন বলছে-লিখছে, যেন আমি মানবতার শত্তুর। কিন্তু জনতা কী ভাবছে? যারা ভোট দেবে? যারা নিত্যি এই আচাভুয়া লোকগুলোর কাঁধ ঘেঁষে বাসে-মেট্রোয় যেতে বাধ্য হয়? তারা আমায় দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করছে। আমার লকেট গড়িয়ে বুকে ঝোলাচ্ছে। কারণ, কথাগুলো সত্যি। মানে, ওদের মনোমত সত্যি, ওদের দগদগে ছ্যাঁকায় মলম-সত্যি।

আরে ভাই, আগে লোকে শান্তিতে বাস করত, তখন অসাম্প্রদায়িক আগডুম-বাগডুমের একটা মানে ছিল। থালায় বার্গারের নিশ্চিন্দি থাকলে মহামানবের সাগরতীরে হা-ডু-ডু খেলা যায়। এখন কী সব অর্থনীতির ঝঞ্ঝাট পেকেছে, কখন কার চাকরি চলে যাচ্ছে তার ঠিক নেই, এই রিসেশন আসে তো ওই নামজাদা কোম্পানি লাটে ওঠে, এর মধ্যে লোকে নিজের গুরগুরে ভয়টাকে নিয়ে রাখবে কোথায়? তাকে তখন ওই ভয়টাকে ঘেন্নায় বদলে নিয়ে ছুড়ে দেওয়ার একটা টার্গেট দেখাতে হয়। তোমার সব দুর্দশার জন্যে দায়ী ওই লোকগুলো, উদ্ভট দেখতে, ক্যালরব্যালর করে অন্য ভাষায়, যারা তোমার দেশে এসে, তোমার ভাত মারছে— এই কথাটা স্টেজে উঠে চেঁচিয়ে বলে দিতে হয়। এমনিতেই সে এটাই ভাবছিল, মনে মনে ফুঁসছিল, এ বার লাফিয়ে ওঠে। নেতা-টেতারা এগুলোকে এড়িয়ে চলে, কারণ আজকাল এক রকম ন্যাকা ন্যাকা আধো-আধো পৃথিবীর চল হয়েছে। কিন্তু আমি যখন আমার কোটিপতির গুমোর আর দাবড়ানি মূলধন করে ফটাস ফটাস বিদ্বেষের বোম ফাটাতে শুরু করলাম, ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’কে লাথি মেরে উড়িয়ে দিতে বললাম, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে করে তুললাম হটকে ক্যান্ডিডেট, হটও বটে, আর ইলেকশনের জগাখিচুড়িটাকে দিলাম একটা তুখড় টুইস্ট। না, আমি অংক বুঝি না, বড় বড় আবছা ঝাপসা তত্ত্ব কপচাই না, ইতিহাস জানতে আমার বয়ে গেছে, আমি খুব সরলসিধে থাবড়া মারি। গোদা, বোদা থাবড়া। তাই আমার সঙ্গে যারা লড়তে এসেছে তাদের শিক্ষিত মুখের বাক্যি নিমেষে হরে যায়।

এখন আমার দোসরেরাই সর্বত্র গজাচ্ছে। ব্রিটেনে আর ফ্রান্সে পার্টি তৈরি হয়েছে, যারা বলছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে সরে এসো, আর সব বিদেশিগুলোকে ঘেঁটি ধরে তাড়াও। আগের মতো আপনি আর কোপনি নিয়ে বাঁচব। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে গজাচ্ছে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী নিজে শরণার্থীদের মুখের ওপর কাঁটাতারের বেড়া তোলার কথা বলছেন। যখন রিফিউজিদের ঢল নেমেছিল, আমার মতো কয়েক জন বলেছিল, মার! তাড়া! মহৎ সাজার লোভে সে চেতাবনি শোনা হল না। এ বার লাও, বোম সামলাও। আমি আমার সভায় অন্য রকম দেখতে লোক প্রশ্ন করতে উঠলে তাকে কথাই বলতে দিই না। বলি, তোমাকে মেক্সিকান সরকার পাঠিয়েছে, না? ব্যস, হাসি আর হাততালি। আমি তো বলেছি, প্রত্যেকটা মেক্সিকানকে তাড়াব। তার পর একটা বড় পাঁচিল তৈরি করব আমেরিকার চারপাশে। যাতে কেউ না ডিঙোতে পারে। একটা সুন্দর গেট থাকবে অবশ্য। আরে, মেক্সিকান সরকার ইচ্ছে করে ওদের সব বাজে লোকগুলোকে আমাদের দেশে চালান করে দেয়: যা, ড্রাগ খাওয়া, ক্রাইম কর। মেক্সিকানগুলো তো সব রেপিস্ট। হ্যাঁ, স্ট্রেট বলে দিয়েছি। কীসের ভয়? কীসের বাধো-বাধো? চিনকেও হুঁশিয়ারি দিয়েছি। আমি প্রেসিডেন্ট হলে ওদের বাণিজ্য-বুলডোজারের ব্যথা আছে। আমায় যখন বলা হয়েছে, নিও-নাৎসিরা আর সাদা ফ্যাসিস্টরা আমাকে সাপোর্ট করছে, উত্তর দিয়েছি, ভাল তো, আমাকে সব্বাই ভালবাসে। এই ঠোঁটকাটা ঔদ্ধত্যই তো সত্যিকারের বীরের, প্রেসিডেন্টের স্পিরিট। যেটা গদিতে আছে, ওটা তো মেনিমুখো। তার ওপরে কালো। বাজি রাখছি, ওর বার্থ সার্টিফিকেট দেখা হোক। শিয়োর গোলমাল হ্যাজ।

হ্যাঁ, আমি বলেছি, এত শীত পড়েছে, তা হলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে কোথায়? বলেছি, ছোট ছোট বাচ্চারা কি ঘোড়া, যে তাদের ভ্যাকসিনের নামে গাদা গাদা ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে? আমাকে অনেকে ক্লাউন বলছে। কিন্তু আমিই আমজনতার আত্মা। জানবি, মানুষ কমিক্‌সই পড়তে চায়, ছোট হরফের নিবন্ধ নয়। সে গণতন্ত্র-টন্ত্র বোঝে না, সে স্রেফ চায় তার নেতা হবে সুপারহিরো। ভিলেনদের গদাম গদাম ঘুসি কষাবে আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমি এমন ক্যাম্পেন-ডিজাইনে বাণী ঝাড়ি, যেন আমেরিকা একটা কোম্পানি, আমি হব তার সিইও। বাকি বিশ্ব আমার সঙ্গে ব্যবসায় দাঁও মারার চেষ্টা করছে। আমি তাকে সব ডিল-এ ল্যাং মারব। আমার প্রজারা, যারা সবাই সাদা আর সিধে, যারা স্কি করে কিন্তু চমস্কি পড়ে না, তারা আমাকে পুজো করবে, কারণ আমি বড়লোক, জয়ী, উইগ পরি না, আমার অাইকিউ সাংঘাতিক, আমি সব মেয়েদের টুসকি মেরে তুলতে পারি, আমি যুদ্ধু করে সবাইকে হারিয়ে সিংহাসনে বসে ঊরু চাপড়াব, তার তালে তালে জাতীয় সংগীত বাজবে।

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE