প্রতিনিধি। দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচিত সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। ২৫ জুন, ২০১৪। ছবি: রবিন রাই।
ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং কেন্দ্রকে ঘিরে আবেগ-অনিশ্চয়তা আর প্রাপ্তির হিসেবনিকেশ সম্পর্কে আঞ্চলিক, প্রাদেশিক ও জাতীয় রাজনৈতিক মহল খুবই উদ্গ্রীব ছিল। তার কারণও ছিল। দার্জিলিং কেন্দ্রের চরিত্র পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য লোকসভা কেন্দ্র থেকে গুণগত ভাবে আলাদা। পাহাড় ও সমতলের প্রকৃতি ভিন্ন চরিত্রের, ভাষাও আলাদা। এর থেকে উদ্ভূত সাংস্কৃতিক ভিন্নতা দার্জিলিং জেলার সামগ্রিক ঐতিহ্যের বাস্তব রূপ। এর প্রভাবে দার্জিলিঙের রাজনীতির এক স্বতন্ত্র গতিপথ সূচিত হয়েছে। তাকে পৃথগীকরণের রাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল হয় না।
স্বাধীন ভারতে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী পরিসরে পৃথগীকরণের রাজনীতিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছে। কৌম সচেতনতা-নির্ভর স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রত্যক্ষ সক্রিয়তায় দার্জিলিঙের পৃথক জাতিসত্তার আন্দোলন এক প্রধান রাজনৈতিক সম্পদের আধারে পরিণত হয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হয় না। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত গোর্খা লিগ, আশির দশক ও তার পরবর্তী সময়ে সুবাস ঘিসিঙের গোর্খা রাষ্ট্রীয় মুক্তি মোর্চা (জিএনএলএফ) এবং ২০০৭-এর পরবর্তী সময়কালে বিমল গুরুঙ্গের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতৃত্বের এই পালাবদল সত্ত্বেও দার্জিলিঙের রাজনীতিতে পৃথগীকরণের দাবি কিন্তু ‘ক্লিশে’ হয়ে যায়নি কখনও। আবার অন্য দিকে, মূলধারার জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলিও সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই বিভিন্ন সময়ে গোর্খাল্যান্ডের পালে হাওয়া পাইয়ে দেওয়ার রাজনৈতিক চমক দিয়ে ‘গোর্খা ভোটব্যাংক’-কে করায়ত্ত করতে সচেষ্ট হয়ে এসেছে।
আশির দশক থেকে ভারতীয় নেপালিদের পৃথক গোর্খা সত্তার আন্দোলন রাজ্যের দাবিতে পর্যবসিত হওয়ার পরেই ‘গোর্খা ভোটব্যাংক’-এর ধারণা বাস্তবতার জমিন খুঁজে পায়। পৃথক রাজনৈতিক সত্তার আন্দোলন পার্বত্য দার্জিলিঙের বিবর্তমান ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলেও সুবাস ঘিসিঙের আগে প্রশ্নাতীত নেতৃত্ব কায়েমকারী স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা ছিল দূর অস্ত্। যদিও অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকেই একমাত্র স্থানীয় দল হিসেবে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে এসেছিল, তবু গোর্খা কৌমসত্তার একমুখী রাজনৈতিক নির্মাণ করতে বা গোর্খা জাতির একমাত্র রাজনৈতিক আধার হিসেবে লিগ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। ১৯৮০-র পূর্ববর্তী নির্বাচনী ফলাফল এবং ভোটের রাজনীতিতে আপস ও দর-কষাকষির জটিল অঙ্ক এই ইঙ্গিত বহন করে। তাই আমরা দেখি, ১৯৫৭ সাল থেকেই দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে গোর্খা লিগ হয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক গাঁটছড়া বেঁধেছে, নয় স্বতন্ত্র ভাবে নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। কোনও রাজনৈতিক কৌশলই কিন্তু গোর্খা লিগকে ১৯৫৭-৭৭ এই সময়কালে সংগঠিত পাঁচটি লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য এনে দিতে পারেনি।
পক্ষান্তরে, সুবাস ঘিসিঙের সময়কাল থেকে গোর্খা আন্দোলনের জঙ্গি স্বরূপ গোর্খাল্যান্ডের দাবির মধ্যে দিয়ে যে বিষয়টি রাজনৈতিক কারবারিদের কাছে পরিষ্কার করে দেয়, তা হল, ‘গোর্খা ভোটব্যাংক’ করায়ত্ত করার মধ্য দিয়েই নির্বাচনী বিজয় সুনিশ্চিত করা সম্ভব। ১৯৯১ ও ২০০৪-এ কংগ্রেসের বিজয় বা সাম্প্রতিক অতীতের (২০০৯) ও এ বারের (২০১৪) লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র জয় ‘গোর্খা ভোটব্যাংক’-এর উপর ভিত্তি করেই সম্ভবপর হয়েছে। রাজনৈতিক মতাদর্শ (বিজেপির হিন্দুত্ব বা কংগ্রেসের উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিকতা) বা ব্যক্তি-নেতার জনমোহিনী স্বরূপ (বর্তমানের নরেন্দ্র মোদী বা অতীতের রাজীব গাঁধী) এ সব কিন্তু দার্জিলিঙের ভোট-রাজনীতির নিয়ন্তা নয়। বস্তুত গোর্খা কৌম সত্তার আত্তীকৃত ভোট দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের ভোট-রাজনীতির জিয়নকাঠি। যে রাজনৈতিক দল এই জিয়নকাঠি করায়ত্ত করতে পেরেছে, নির্বাচনী নিয়তি তারাই নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে।
১৯৮০-র পর থেকে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে গোর্খা কৌমসত্তা-ভিত্তিক ভোটদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আজ সেটা উপলব্ধি করা খুবই দরকার। একদা সুবাস ঘিসিঙের নেতিবাচক আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপুলসংখ্যক গোর্খা ভোটার তাঁদের ভোটদানের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করা থেকে বিরত ছিলেন, আবার তাঁরাই সাম্প্রতিক কালে বিমল গুরুঙ্গের সদর্থক আহ্বানে রেকর্ড পরিমাণ ভোট দিয়ে বিজেপি’কে জিতিয়েছেন। এ সবই গোর্খা কৌমসত্তা-ভিত্তিক একচ্ছত্র ভোট প্রদানের (যাকে বলে এথনিক ব্লক ভোটিং) ইঙ্গিত বহনকারী সামাজিক তথা রাজনৈতিক ঘটনা।
সঙ্গের সারণি থেকে বোঝা যায়, দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে ঠিক ভাবে, অর্থাত্ সার্বিক ভোট হলে প্রধানত পার্বত্য দার্জিলিঙের ‘গোর্খা ভোট’ই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করে। ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সময়কালে সংগঠিত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও বিজেপির জয় কিন্তু সমতলের ভোট দ্বারা নির্ধারিত হয়নি। শতাংশের বিচারে পার্বত্য দার্জিলিঙের গোর্খা ভোট-এর অবদান সমতলের মোট প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ঢের বেশি। ২০০৯-এর পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনে এই পরিমাণ ছিল সর্বাধিক ৮২.৮৬ শতাংশ। অন্য দিকে, ১৯৯৯-এর ত্রয়োদশ লোকসভা ভোটকে সার্বিক নির্বাচন বলা মুশকিল, কারণ সে বার পার্বত্য দার্জিলিঙে ভোটদানের হার ছিল মাত্র ১০.০৯ শতাংশ। তাই, সেই নির্বাচনে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে সিপিআই(এম)-এর জয় রাজনৈতিক মতাদর্শ, নীতি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে, এ কথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না। ঘটনা হল, দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে যখন আংশিক ভোট হয় বা যখন পার্বত্য দার্জিলিঙের গোর্খা ভোটারদের অংশগ্রহণ থাকে নগণ্য, শুধু তখনই সমতলের ভোট নির্বাচনী ফলাফলে নির্ণায়কের ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়। ত্রয়োদশ নির্বাচনে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে বিজয়ী সিপিআই এমের প্রাপ্ত আড়াই লক্ষাধিক ভোটে (২,৫৬,৮২৬) পার্বত্য দার্জিলিঙের অবদান মাত্র ৯ শতাংশ (৯.৪২%)। শ্রেণি-রাজনীতির বিজয় কৌম-সচেতনতাভিত্তিক রাজনীতিকে পরাভূত করেছে, এ রকম সিদ্ধান্তও একপ্রকার অমূলক। বরং লোকসভা নির্বাচনের পরম্পরায় কৌম-সচেতনতা তথা সত্তার রাজনীতির অভিজ্ঞতা উল্টো কথা বলে। আশ্চর্যের হলেও সত্যি যে, পার্বত্য দার্জিলিঙের ৪৩.২২ শতাংশ ভোটার সমতলের ৫৬.৭৮ শতাংশ ভোটারদের রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের সমস্ত হিসেবনিকেশ বানচাল করে দিতে পারে। অর্থাত্, সংখ্যাধিক্যের সরল পাটিগণিত নয়, কৌম-সত্তার জটিল রসায়নই দার্জিলিং জেলার ভোট-রাজনীতির চালিকা শক্তি। এই সহজ সত্য যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায়, গণতান্ত্রিক বাতাবরণের পক্ষে ততই মঙ্গল।
এ হেন পরিস্থিতিতে ‘দার্জিলিংকে বাংলা থেকে ভাগ হতে দেব না’ বা ‘গোর্খাল্যান্ড অসম্ভব’ জাতীয় জাতিগর্বী নির্বাচনী স্লোগান গোর্খা আত্মশ্লাঘাকে প্রশমিত তো করেই না, উপরন্তু এ জাতীয় প্রচার কৌমসত্তা-নির্ভর ভোট প্রক্রিয়ার জারণে অনুঘটকের কাজ করে। যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচনী রাজনীতির দ্বারাই কৌম-সত্তার রাজনীতির মোকাবিলা করতে হয়, তা হলে বোধ হয় রাজনৈতিক কারবারিদের আরও যুক্তিনির্ভর ও বাস্তববাদী হওয়া প্রয়োজন। গোর্খাল্যান্ড হবে কি হবে না, এই জাতীয় রাজনৈতিক বার্তা ভোটের রাজনীতিতে গোর্খাল্যান্ডের দাবিদারদেরই রাজনৈতিক সুবিধে করে দিচ্ছে। তার ফলে গোর্খাল্যান্ডের দাবি রাজনৈতিক ভাবে আরও তীব্র ও ক্ষুরধার হয়ে উঠছে। লোকসভা নির্বাচন ও নির্বাচনী রাজনীতিতে গোর্খাল্যান্ড প্রশ্নটির রাজনৈতিক ব্যবহার দার্জিলিং কেন্দ্রে ভোটে জেতার শক্তিশালী কৌশল হলেও পরিশেষে তা কিন্তু গোর্খাল্যান্ডের দাবিদারদেরই অতি-উত্সাহী করে তোলে। এবং শুধু তা-ই নয়, এক অর্থে এই কৌশলের ক্রমাগত সাফল্য গোর্খাল্যান্ডের দাবির জনভিত্তিকেই প্রতিষ্ঠা করে।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy