পঁয়ত্রিশ বৎসরে বাম শাসনে কেবল পশ্চিমবঙ্গবাসীই স্থিতাবস্থার দাস হইয়া পড়েন নাই। বাম ফ্রন্ট নিজেও স্থিতির মধ্যে মগ্ন হইয়া গিয়াছিল। এত দিনে সেই মগ্নতার স্বরূপটি পুরাপুরি বুঝা যাইতেছে। বাম নেতারা একটানা ক্ষমতায় থাকিতে থাকিতে বিরোধিতা করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। আন্দোলন তৈরি করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। রাজনীতির শিল্পটিই বিস্মৃত হইয়াছেন। তাই তাঁহাদের সম্মুখে রাজনীতির উপকরণসমূহ আনিয়া দিলেও তাঁহারা বিহ্বল হইয়া থাকেন, কী ভাবে ‘ব্যবহার’ করিবেন বুঝিতে পারেন না। রাজনীতির উপাদেয়তম অন্নব্যঞ্জন রাঁধিয়া মুখের সামনে ধরিলেও খাইয়া উঠিতে পারেন না। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ যখন নৈরাজ্যের গ্রাসে, শাসকের দলীয় সন্ত্রাস যখন সর্বত্র পরিব্যাপ্ত, প্রশাসনের সহিত গভীর ও অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত ছোট-বড় নেতারা যখন খুন, ধর্ষণ, তোলাবাজি, দুর্নীতি করিয়া বহাল তবিয়তে ফিরিতেছেন, এবং পুলিশ অভিযুক্তদের ‘খুঁজিয়া পাইতেছে না’, বামপন্থীদের মুখে কিন্তু আশ্চর্য কুলুপ। তাঁহারা হয় মৌনব্রত নয় অহিংসব্রত অবলম্বন করিয়াছেন। আর পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতির ভাগে পড়িয়াছে বিরাটাকার ঢ্যাঁড়া।
তাই সারদা কেলেংকারির উন্মোচন পর্বে এখনও পর্যন্ত রহস্য রোমাঞ্চ আছে, কিন্তু রাজনীতির উত্তাপ নাই। সিবিআই তদন্তে একের পর এক বিস্ফোরক দুর্নীতি, জালিয়াতি ও প্রতারণায় শাসকদের জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ নিত্য প্রকাশিত। সাংসদ, প্রভাবশালী রাজনীতিকরা জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন। মন্ত্রীদের প্রাক্তন আপ্তসহায়ক ও স্নেহধন্যরাও সিবিআই হেফাজতে। কিন্তু চিট-ফান্ডে গচ্ছিত ১৭ লক্ষ দরিদ্র আমানতকারীর অর্থ লুঠের কারবারে অভিযুক্ত শাসকদের বিরুদ্ধে বিরোধী দল হইয়াও বামপন্থীরা আন্দোলনের চৌকাঠ মাড়াইতেছেন না। যাঁহারা আগে কথায় কথায় বন্ধ কিংবা মিছিল শুরু করিয়া দিতেন, তাঁহাদের আজ টিকিটিও বহু সাধনায় দেখা যায়। মনে হয়, বাম নেতারা গোস্বামী-ধর্মে অভিষিক্ত হইয়াছেন, কামড়ানো কিংবা ফোঁস করা, সব কিছুরই ঊর্ধ্বে বিচরণ করিতে চাহেন বুদ্ধদেব গোঁসাই, বিমান গোঁসাই, কিংবা সূর্যকান্ত গোঁসাই!
তর্ক উঠিবে, এই যে তাঁহারা বুধবার পরিবহণের প্রশ্নে সিটুর মিছিল নামাইলেন, তবে? কিংবা এই যে রাজ্য কোঅর্ডিনেশন কমিটি সমাবেশ ঘটিল, তবে? বিশেষ বিস্তারের দরকার নাই, নেতারা নিজেরাই জানেন, মিছিল-মিটিং কোনওটিই বিশেষ জমে নাই, পথে নামিলে তবে তো পথ চেনা। কথাটি জানেন বলিয়াই এক নেতা দূরদর্শন চ্যানেলে মন্তব্য করিলেন, এখন পূজার মরসুম, পূজা মিটিলে তাঁহারা দেখাইয়া দিবেন বিরোধিতা কাহাকে বলে। এ যেন সেই সধবার একাদশীর গানটির মতো পরিস্থিতি, তাঁহারা যেন ‘মৃতদেহে জীবনসঞ্চার’ করিতে নামিবেন। অজুহাতই অভাবের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। রাজনীতি করিবার উপায় নাই বলিয়াই উপযুক্ত দিনক্ষণের এমন প্রতীক্ষা। নেতারা ভুলিয়া যাইতেছেন, বাম কার্যক্রমে কোনও কালেই শারদীয়া পূজা বাধা হইয়া দাঁড়ায় নাই। ইহাও ভুলিতেছেন যে, বেশি সময় পার হইয়া গেলে শত চেষ্টায়, শত বাণীতেও মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার হইবে না। মানুষের সমর্থন তাঁহাদের জন্য মৃত। এই মরণ হইতে নূতন নির্মাণ যদি সত্যই করিতে হয়, তবে শারদীয় অবকাশ লইলে চলিবে না। রাজনীতিতে শূন্য স্থান হয় না। বাম নিশ্চেষ্টতার অবকাশেই জবরদস্ত জমি তৈরি করিয়া লইবে বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy