Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ঘাতক

মু ক্ত বুদ্ধির শাস্তি মৃত্যু। ভারত কি তবে এই বিধানকেই শিরোধার্য করিবে? গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে কথা বলিবে, তাহাকেই প্রাণ দিতে হইবে? কর্নাটকে প্রবীণ শিক্ষক ও সাহিত্যিক এম এম কালবার্গির হত্যাকাণ্ড এই প্রশ্ন তুলিতেছে। ইহাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলিয়া তুচ্ছ করিবার কোনও উপায় নাই। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে গোবিন্দ পানসারেকে একই ভাবে প্রাণ দিতে হইয়াছিল।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

মু ক্ত বুদ্ধির শাস্তি মৃত্যু। ভারত কি তবে এই বিধানকেই শিরোধার্য করিবে? গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে কথা বলিবে, তাহাকেই প্রাণ দিতে হইবে? কর্নাটকে প্রবীণ শিক্ষক ও সাহিত্যিক এম এম কালবার্গির হত্যাকাণ্ড এই প্রশ্ন তুলিতেছে। ইহাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলিয়া তুচ্ছ করিবার কোনও উপায় নাই। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে গোবিন্দ পানসারেকে একই ভাবে প্রাণ দিতে হইয়াছিল। দুই বছর আগে পুণেতে নরেন্দ্র দাভোলকরের হত্যার স্মৃতিও এখনও অনেকের মনেই উজ্জ্বল। তাঁহাদেরও ওই একই অপরাধ ছিল: মুক্ত বুদ্ধি পোষণ করা এবং তাহার কথা সাহসের সহিত উচ্চারণ করা। এবং, অন্যদের মতোই কালবার্গিও ইতিপূর্বে তাঁহার যুক্তিবাদী কথাবার্তার জন্য জঙ্গি গোঁড়াদের বিস্তর গালিগালাজ এবং এমনকী প্রাণহানির হুমকিও শুনিয়াছেন। তাঁহার বাড়িতে চড়াও হইয়া যে আততায়ীরা তাঁহাকে হত্যা করিয়াছে, তাহাদের আগমন আকস্মিক হইলেও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত বলিবার কোনও উপায় নাই। এই আক্রমণগুলি দৃশ্যত একটি সূত্রে বাঁধা। তাহা মারমুখী অসহিষ্ণুতার সূত্র।

বিপরীত মতের মানুষকে সহ্য না করিবার, তাঁহাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাইবার, তাঁহাদের শারীরিক আঘাত করিবার, এমনকী হত্যা করিবার জঙ্গি অসহিষ্ণুতা সর্বকালেই দেখা গিয়াছে। এক কালে খাস ইউরোপে সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতির নায়করা রীতিমত অনুষ্ঠান করিয়া ভিন্নমতের মানুষদের আগুনে পুড়াইয়া মারিতেন। কিন্তু যুগ বদলাইয়াছে। আজ সভ্যতার একটি প্রাথমিক শর্ত হিসাবে এই নীতি স্বীকৃত যে, বিভিন্ন মতামত একই সঙ্গে বজায় থাকিবে, তাহাদের তর্ক চলিবে, কিন্তু সেই কারণে কাহাকেও আক্রান্ত হইতে হইবে না, কাহারও প্রাণহানির প্রয়োজন হইবে না। আজও অনেক দেশেই এই নীতি স্বীকৃত হয় নাই, ‘ধর্মীয় অবমাননা’ কিংবা রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণের অপরাধে চরম শাস্তি দেওয়ার রীতি সেখানে প্রচলিত। কিন্তু তাহারা সচরাচর গণতন্ত্রের অনুসারী নহে। আধুনিক উদার গণতন্ত্রে এ ধরনের অসহিষ্ণুতাকে অন্যায় হিসাবেই দেখা হয়। ভারতেও তাহাই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের তুলনাতেই এ বিষয়ে ভারতের অবস্থা তুলনায় ভাল, এখানে বহু মত, এমনকী বহু ‘চরমপন্থী’ মতও খোলাখুলি প্রচার করা চলে— এমন ধারণা প্রচলিত আছে।

হয়তো আর বেশি দিন থাকিবে না। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণুতা দ্রুত বাড়িয়া চলিয়াছে এবং তাহা প্রতিরোধের উদ্যোগ ক্রমশ ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িতেছে। এখানেই প্রশাসনের বড় দায়িত্ব। ‘তোমার কথা পছন্দ করি না, সুতরাং তোমাকে হত্যা করিব’ বলিয়া যাহারা ভিন্নমতের অনুগামীদের উপর চড়াও হয়, তাহারা নিজেরা উদার গণতন্ত্রের বাণী শুনিবে না, সহিষ্ণুতার অনুশাসন মানিবে না, তাহা বুঝিতে কিছুমাত্র অসুবিধা নাই। তাহাদের কঠোর ভাবে মোকাবিলা করিতে হইবে। ভয়ের কথা, সচরাচর প্রশাসনের কর্তারা সেই কঠোর মোকাবিলায় তৎপর হন না। আরও বড় ভয়ের কথা, যাঁহারা প্রশাসনের শীর্ষে, সেই রাজনৈতিক নায়করাও এ ধরনের অসহিষ্ণুতাকে প্রচ্ছন্ন ভাবে, কখনও বা প্রত্যক্ষ ভাবে প্রশ্রয় দিয়া থাকেন। নরেন্দ্র মোদীর ‘সর্বাধিক প্রশাসন’ এই ধারা বদলাইতে পারে নাই, বরং তাঁহার দলের অনুগামী অথবা স্বজনপ্রতিম নানা সংগঠনের অসহিষ্ণুতার দাপট গত এক বছরে বাড়িয়াছে। কর্নাটকের ঘটনাটিতেও তাহাদের জড়িত থাকিবার অভিযোগ উঠিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী এই ধরনের আক্রমণ বা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কী বিবৃতি দিলেন, তাহা বড় কথা নয়, কিন্তু ভারত নামক দেশটিকে মুক্ত বুদ্ধির পক্ষে নিরাপদ রাখিবার দায় তিনি অস্বীকার করিতে পারেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE