Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

চড় খেলেও টিআরপি

আরে এ দেশে ক্রিকেটটা ব্যাট দিয়ে খেলা হয় না, ইমোশন দিয়ে হয়। ওয়ার্ল্ড কাপে হেরে গেলে অ্যাভারেজে চৌত্রিশটা লোক হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়, তিন জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে, বাথরুম থেকে মা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল বলে শেষ অবধি পারে না। সে দেশের ক্রিকেটার টালমাটাল টাইপ হবে না? যে কিনা ফুটন্ত ডেকচির দুধের মতো এক বার বগবগিয়ে উথলে পড়ছে, তার পরেই চোঁওও ভেতরটায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে?

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আরে এ দেশে ক্রিকেটটা ব্যাট দিয়ে খেলা হয় না, ইমোশন দিয়ে হয়। ওয়ার্ল্ড কাপে হেরে গেলে অ্যাভারেজে চৌত্রিশটা লোক হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়, তিন জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে, বাথরুম থেকে মা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল বলে শেষ অবধি পারে না। সে দেশের ক্রিকেটার টালমাটাল টাইপ হবে না? যে কিনা ফুটন্ত ডেকচির দুধের মতো এক বার বগবগিয়ে উথলে পড়ছে, তার পরেই চোঁওও ভেতরটায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে? বয়সের তেজ, ইন্ডিয়ার জার্সি পরার গৌরব, কাঁচা টাকা হাতে পাওয়ার দাপট, সারা দেশে নাম ছড়িয়ে যাওয়ার তৃপ্তি, এগুলোকে রেলিশ করে ভোগ করতে গেলে তো জীবনটাকে স্যান্ডো গেঞ্জির মতো আটপৌরে পরে থাকলে চলবে না রে ভাই, হইহই করে লাল টকটকে ডিউস বলের মতোই নিজেকে ছুড়ে দিতে হবে, ক্যাচ মিস সেও ভি আচ্ছা। আমাদের মতো নবীন ও কাঁচাদের ডিসিপ্লিন বা নীতির নিগড়ে বেঁধে রাখা যায় না। ও সব তো জেঠুমার্কা লোকের জন্যে, যারা মরা কালারের প্যান্ট পরে। মন দিয়ে নিজেকে তৈরি করব, যুগ যুগ ধরে খেলে চলব, গাদা গাদা রেকর্ড গড়ব, এ সব আবার কী? চাড্ডি বাঁধাকপির পাতা খেয়ে সন্ধেবেলায় শুয়ে পড়লি? নাম কামিয়ে তা হলে কী হল? নাইটক্লাবে যা, আচ্ছাসে কোমর হিলা, সাধনার আশেপাশে যত রকম বেনিফিট সব নিংড়ে এনজয় কর! দু’দিনের জিন্দেগি বস, বোল্ড হয়ে যাওয়ার আগে বেধড়ক চালিয়ে খেলো।
আমাকে আপনারা দেখেছেন তো, আইপিএলে হরভজনের কাছে থাপ্পড় খেয়ে কী কান্নাটাই কেঁদেছিলুম! অবশ্য রিপোর্টাররা যখন জিজ্ঞেস করল কিছু নালিশের সাহস হয়নি, ‘ও আমার বড়দাদার মতো’ বলে চালিয়ে দিলাম, কে জানে কোত্থেকে কী লাগিয়ে দেবে আর টিমে চান্স ঘুচে যাবে, কিন্তু শিশুর মতো ফুলে ফুলে কান্না দেখে কি আপনারা বলেননি, আহা, কী পবিত্র ইমোশনাল! সত্যি বলব? টিভি ক্যামেরার সামনে ভ্যাঁ মারতে হেভি লাগছিল! এখন আবার নিজের ফেমিনিন সাইডের সঙ্গে ওঠাবসা থাকলে মেয়েরা বিশেষ পাত্তা দেয়। তা ছাড়া, আমাদের মোটো: যে ভাবে হোক নিজেকে টিভিতে বারবার দেখিয়ে যাও। বোলিং না পারলে চেঁচামেচি করো, বিপক্ষ প্লেয়ারকে দৌড়ে অপমান করো, কিছু না হোক দাঁত ছরকুটে মুচ্ছো যাও। কিন্তু লাইমলাইট তোমাকে খেতেই হবে। আমি একটা অমন চড়ের পর ভিকটিম সাজার টিআরপি ছেড়ে দেব? সারা ভারতের সামনে গ্লিসারিন ছাড়া অতখানি কান্না! উফ!

তার মানে এই নয় আমি অ্যাগ্রেসিভ নই। ও বাবা, সে ফিল্ডেও যা নামিয়েছি, সব্বার চক্ষু চড়কগাছ! হাসিম আমলাকে আউট করার পর তো এমন বিচ্ছিরি অঙ্গভঙ্গি করেছিলাম, আমার ম্যাচ ফি-র ৩০% কেটে নেওয়া হল! মাইকেল ভন-কে কাঁধ দিয়ে অ্যায়সা ধাক্কা কষিয়েছি, পিটারসেনকে এমন এক পিস বিমার ছুড়েছি, চার পাশে হইহই নিন্দে! টেরিফিক ভালবাসি এগুলো। আমার হল নাগরদোলা থিয়োরি। উঠি আর নামি, লোকে যেন বোঁ-বোঁ দেখে বোমকে যায়!

এক বার, দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দ্রে নেল আমাকে বল করার সময় পুরো গায়ে ছুড়ছে! একটা বল তো প্রায় হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিত! বাব্বা, কোনও মতে বেঁকেচুরে এড়িয়েছি, সে ব্যাটার নিজের বুকের দিকে আঙুল দেখিয়ে ইশারা করছে, আমার কলজেয় সাহস নেই। পরের বলটাতেই ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে এসে, ব্যাটার মাথার ওপর দিয়ে পুরো তুলে ছক্কা! ওঃ! কী সপাট জবাব! এর পর এট্টু সেলিব্রেশন না করে থাকা যায়? ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে ব্যাট ঘোরালাম, পিচে এক পিস সু্প্পার ড্যান্স দিলাম! অবশ্য সে বার জার্সির তলায় ব্র্যান্ডেড জামা পরেছিলাম বলেও বকুনি খেলাম। কিন্তু বাওয়া, এ সব না হলে জমে? যে আমাকে ব্যঙ্গ করবে, আমি তাকে দুশো গুণ বিদ্রুপ ফিরিয়ে দেব না? ফাস্ট বোলার হয়েছি, আউট করার পর অসভ্যতা করব না? তা ছাড়া, অপোনেন্টকে খিস্তি, অপমান, এ সব যারা পারে না, তারা আধুনিক ক্রিকেটেই অচল। অস্ট্রেলিয়ানদের জিজ্ঞেস করো না, ওরা তো এগুলো করেই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন! অবশ্য খেলতেও বেশ ভালই পারে। তা, আগে ইজি জিনিসগুলো শিখছি, ক্ষতি কী?

আসলে, নামও করেছি, আবার ইমোশনাল ডায়রিয়া-ও আছে, তাই শত্তুররা ভালই পিছনে লাগতে পারে! মাঠের মধ্যে, মাঠের বাইরে, সর্বত্র কনডাক্টের জন্যে আমায় কড়কানো হয়েছে। আরে, আমি কি কন্ডাক্টর নাকি? উইকেট পেয়ে এক্সট্রা উল্লাস দেখিয়েছি, বকুনি। রঞ্জি ট্রফির টিম ক্যাম্পে যাইনি, বকুনি। তবে, এ সব করে তো আর মাল্টিশাখা জিনিয়াসকে আটকানো যায় না! পিচ থেকে নাচের ব্যাপারটা রিয়েলিটি শো অবধি টেনে নিয়ে গেলাম। যদিও সেখানে আবার লেগে গেল মাধুরী দীক্ষিত আর রেমো-র সঙ্গে। জাজ হয়েছ তো কী হয়েছে, আমার নাচের নিন্দে করবে! সেট থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেলাম! তাতে অবশ্য কিস্যু এসে যায় না, সিনেমা করছি। ক্রিকেট থেকে যারা আমায় তাড়িয়েছে, তারাই এসে অটোগ্রাফ চাইবে, দেখো না!

হ্যাঁ, তিহাড় জেলে গিয়েছি, সুইসাইডের কথাও ভেবেছি। হিরোদের এ সব ট্র্যাজেডি সইতেই হয়। আবার তাদের জীবনেই মিরাক্‌ল কড়া নাড়ে! আমায় বেকসুর খালাস দেওয়া হল! হ্যাঁ, মূল কত্তারা এখনও ব্যান ওঠায়নি, কিন্তু তা নিয়েও লড়ে যাব। আরে ভাই, স্পট ফিক্সিং করেছি না করিনি, সে ডিবেট আমার ইমেজের কিস্যুটি ক্ষতি করবে না, বরং মার্কেটে নামটা ভাসিয়ে রাখবে। ওটা ওই চড়েরই মতো! তার পর যদি এক বার টিমে সেঁধিয়ে যেতে পারি, রান-আপ শুরু করেছি কি করিনি, কমেন্টেটররা স্রেফ আমায় নিয়ে বকবক। আর যদি উইকেট পাই, এমন নাচব মাঠ জুড়ে, পরের ঝলক দিখলা যা আটকায় কে! এখন নেটে যাচ্ছি না, নাচের ফিগারটা তুলছি!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cricket india S. Sreesanth IPL court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE