Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

চুনকালি

উ দ্ধব ঠাকরে নিশ্চয় জানেন যে, ভারতে তাঁহার জনপ্রিয়তা যে বিন্দুতেই থাকুক না কেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাজে তাঁহার দাম রাতারাতি হু হু করিয়া বাড়িতেছে।

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:২০
Share: Save:

উ দ্ধব ঠাকরে নিশ্চয় জানেন যে, ভারতে তাঁহার জনপ্রিয়তা যে বিন্দুতেই থাকুক না কেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাজে তাঁহার দাম রাতারাতি হু হু করিয়া বাড়িতেছে। ভারত পাকিস্তান দ্বৈরথে ভারতের দায়িত্বই বেশি, ভারতের অসহনশীলতাই আসলে দুই পক্ষকে ঠেলিয়া ঠেলিয়া আজিকার সংকট-কন্দরে ফেলিয়াছে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ফাঁপা ও লোক-দেখানো, এমনকী গণতন্ত্রও, ইত্যাদি কথা যে সব কট্টর পাকিস্তানি বহু দিন ধরিয়া বিশ্বদুনিয়াকে বুঝাইতে চাহিতেছেন, তাঁহাদের কাজ জলবৎ সরলম্ করিয়া দিতেছেন উদ্ধব ঠাকরে ও তাঁহার শিব সেনা। সপ্তাহে সপ্তাহে তাঁহারা ভারতের অসহনশীলতার নূতন ঝান্ডা উড়াইতেছেন। কেবল হিন্দুত্ববাদের শিঙাই ফুঁকিতেছেন না, অন্ধ পাকিস্তান-বিরোধিতা যে এক গোত্রের ভারতীয়ের রক্তে প্রবল বেগে বহমান, তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ বিশ্বদরবারে পেশ করিতেছেন। গত সপ্তাহে পাকিস্তানি গজলসম্রাট গুলাম আলির সংগীত অনুষ্ঠান মুম্বইতে না হইতে দিবার ব্যবস্থা হইয়াছে। এই সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ কসুরির বই মুম্বইতে প্রকাশিত হইতে বাধা দিয়াও সফলকাম না হওয়ায় প্রকাশ-অনুষ্ঠানের কর্তা বিজেপির সুধীন্দ্র কুলকার্নির উপর কালি-হামলা হইয়াছে। ভারতের সম্মানের উইকেট পড়িলে পাকিস্তানের ছক্কা, এই যদি হিসাব হয়, তবে এই মুহূর্তে পাকিস্তানি টিমে শিব সেনার বাড়া খেলোয়াড় নাই। যে ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জে নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ আসনটির জন্য প্রাণপণ দুনিয়ার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সমর্থন চাহিতেছে, নিজেকে কেউকেটা বলিয়া দাবি করিতেছে, তাহার এই চেহারা দেখিয়া পাকিস্তান ছাড়াও সম্ভবত আর একটি দেশ জনান্তিকে হাসি চাপিতে হিমশিম। তাহার নাম, চিন। অসহনশীলতার সংস্কৃতি লইয়া কম কটু কথা তো শুনিতে হয় না এই দুই প্রতিবেশী দেশকেই। ক্ষমতায় আসা ইস্তক ভারতের মুখোজ্জ্বল করিবার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্বভ্রমণ করিয়া ক্লান্ত। এ বার তিনি একঠাঁই হইয়া ঘরে বসিতে পারেন। কুলকার্নির কালিমাখা মুখটিই বিশ্ব-ক্যালেন্ডারে উঠিয়া গিয়াছে।

সর্ব অর্থেই ইহা নরেন্দ্র মোদীর কর্মফল। কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি শাসন ভারত আগেও দেখিয়াছে। কিন্তু প্রাত্যহিক ভিত্তিতে ধর্মগুন্ডামি দেশবাসীকে সে দিন সহ্য করিতে হয় নাই। কখনও বাড়ি চড়াও হইয়া পণ্ডিত ঐতিহাসিকের নিধন, কখনও মুসলিম পরিবারের প্রৌঢ় কর্তাকে গোমাংস রাখিবার অভিযোগে হত্যা, কখনও পাকিস্তানি বলিয়া শিল্পীর অধিকারে বাধা, কিংবা কুলকার্নির শেষতম ঘটনা: প্রতি ক্ষেত্রেই রাজ্য প্রশাসনের তরফে পদক্ষেপ যথেষ্ট না হইলে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা প্রয়োজন ছিল। কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কাম্য না হইলেও কোন ঘটনায় অন্তত তাঁহার মন্তব্য আবশ্যক, তাহা মোদীর মতো দুঁদে রাজনৈতিক নেতা বুঝেন না ভাবা মুশকিল। বরং ভাবা সহজ যে, তিনি মন্তব্য করেন না কেননা করিতে চান না। তিনি অসহিষ্ণুতা আটকান না কেননা অসহিষ্ণুতা তাঁহার কাছে অগ্রহণযোগ্য নয়।

ইহা যে নিছক নড়বড়ে অনুমান নহে, ভিত্তিপূর্ণ যুক্তি, তাহা মোদীর সরকারের অন্যবিধ কাজকর্মেও পরিষ্কার। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক যে ভাবে ক্রমাগত ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্বে কুঠার হানিতেছে, পাঠ্য পুস্তকে হিন্দুত্ববাদী সম্মার্জনী চালাইতেছে, বিদেশি ভাষার উপর আক্রমণ শানাইতেছে, উচ্চমানের প্রতিষ্ঠানে রাম-যুধিষ্ঠিরকে বসাইতেছে, তাহাতে আর কোন মুখে প্রধানমন্ত্রী শিব সেনার সমালোচনা করিবেন। এমন মাণিক্যখচিত কেরিয়ারের জন্য তিনি ইতিমধ্যেই ভারতের ইতিহাসে অবিসংবাদী স্থানের অধিকারী হইয়া বসিয়াছেন। অবশ্য যদি ভবিষ্যৎ ভারতে সত্যকারের ইতিহাস বলিয়া কিছু অবশিষ্ট থাকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE