পরশুরাম বর্ণিত কবিরাজ যেমন এক দলা চ্যবনপ্রাশ ঠুসিয়া দিয়াই সব রোগ সারাইয়া ফেলিতেন, রাজনীতিকদের নিকট তেমনই এক মহৌষধি বর্তমান। তাহার নাম জাতীয়তাবাদ। ঠুসিয়া দিলেই সব তর্কের অবসান, সব খামতি মাফ। নির্ভয়া-কাণ্ড লইয়া নির্মিত তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া’জ ডটার’-কে কেন্দ্র করিয়া যত অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠিয়া আসিয়াছে, সবের গোড়া মারিয়া রাখিতেও বেশ কয়েক দলা চ্যবনপ্রাশের ব্যবস্থা হইয়াছে। ‘ভারতের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগ উঠিয়াছে, কয়েক দফা এফআইআর দায়ের হইয়াছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথ্যচিত্রটিকে ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন। সম্ভবত তাহা ধর্ষকদের ভাবাবেগে আঘাত করিতেছিল। মোটা দাগের জাতীয়তাবাদে অনেক দায় ঢাকিয়া ফেলা যায়। নির্ভয়া-কাণ্ড এবং তাহার আগে-পরে ঘটিয়া যাওয়া অজস্র ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি-মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারই যে বিশ্বের দরবারে ভারতের মাথা হেঁট করিয়া দিয়াছে, সে বিষয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রটি নহে এই সত্যটিকে ঢাকিতেই জাতীয়তাবাদের ঢাকে কাঠি পড়িয়াছে। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে ঘটা যে কোনও ঘটনায় মন্তব্য করিবার পূর্ণ অধিকার যেমন প্রত্যেক ভারতবাসীর আছে, তেমনই ভারতের যে কোনও ঘটনায় বিশ্বের যে কোনও দেশের নাগরিক মন্তব্য করিবার অধিকারী সে মন্তব্য তীব্র, তির্যক, কশাঘাতসম হইলেও। জেলে বন্দি, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর সাক্ষাৎকার এই ভাবে নেওয়া যায় কি না, এবং তাহা প্রচার করা যায় কি না, একমাত্র এই প্রশ্নটিই উঠিতে পারে। কিন্তু, তাহাতে যদি কোনও আইনি বাধা না থাকে, এই তথ্যচিত্র লইয়া আর কোনও প্রশ্নের অবকাশ নাই। এবং, কোনও কারণেই তাহাকে নিষিদ্ধ করিবার প্রশ্ন নাই।
ধর্ষণকাণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত মুকেশ সিংহের সাক্ষাৎকারটিই অশান্তির মূলে। মুকেশ ধর্ষণের সমস্ত দায় ধর্ষিতার উপর চাপাইয়া দিয়াছে। এক জন অশিক্ষিত, অপরিণতমস্তিষ্ক অপরাধীর নিকট দার্শনিকের প্রজ্ঞা আশা করা অন্যায়। কিন্তু, মুকেশ যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে কথা বলিয়াছে, তাহা পিতৃতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা। শুধু খাপ পঞ্চায়েতের জ্যাঠামশাইরা নহেন, শুধু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক (পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে) নহেন, দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির বরিষ্ঠ নেতারাও বহু বার প্রায় এক ভাষাতেই ঠিক এক কথা বলিয়াছেন। তাঁহারা প্রত্যেকেই পিতৃতন্ত্রের সন্তান। ভারতীয় পুরুষতন্ত্র মুকেশের মনের কথাগুলিকেই ধ্রুব বলিয়া জানে। সেই কথাগুলিই যখন দেশবিদেশে সুতীব্র নিন্দার মুখে পড়িয়াছে, নেতারা স্বভাবতই অস্বস্তিতে। লক্ষণীয়, শাসকদের চাপাইয়া দেওয়া নিষেধাজ্ঞা এখনও বিরোধী শিবিরকে প্রতিবাদের পথে লইয়া যাইতে পারে নাই। সব নেতাই সম্ভবত চাহিতেছেন, তাঁহাদের মনের কথাগুলি দেশের গণ্ডির মধ্যেই থাকুক। দেশবাসীর চেনা কানে কথাগুলি সহিয়া গিয়াছে। বিদেশিরা ভারত বলিতে চিকেন বাটার মসালা আর দশ লক্ষ টাকার স্যুটই চিনুক।
যে কোনও নিষেধাজ্ঞাই বাক্-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, অতএব নিন্দনীয়। ইন্ডিয়া’জ ডটার তথ্যচিত্রটির উপর নিষেধাজ্ঞা কেবল আরও এক দফা বাক্-স্বাধীনতা লঙ্ঘনের উদাহরণ হইয়া থাকিবে না, একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করিবার দৃষ্টান্তও হইবে। মুকেশ সিংহের কথাগুলি যত বেশি ভারতীয়র নিকট পৌঁছাইত, সম্ভবত তত বেশি লোক বুঝিতেন, তাঁহাদের অন্তরাত্মা এক ঘৃণ্য অপরাধীর ভাষায় কথা বলিতেছে, এক ধর্ষকের যুক্তিতেই ভাবিতেছে। হয়তো এই মিল অনেককে ধাক্কা দিত হয়তো তাঁহারা ফিরিয়া ভাবিতেন, নিজেদের ভাবনার ভুলগুলি তাঁহাদের চোখে পড়িত। ধর্ষণ লইয়া শত আলোচনাসভাতেও যাহা হইবার নহে, কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করিয়াও যে মন পাল্টানো যায় না, এই তথ্যচিত্র হয়তো সেই কাজে খানিক হইলেও সফল হইত। পিতৃতন্ত্রের গভীর অসুখ লুকাইয়া রাখিলে এই সমাজের ক্ষতি। রাজনীতি সেই কাজটিই করিতে সচেষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy