Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

জবরদখল

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্বাস, তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে টাকা দেন। অতএব, প্রতিষ্ঠানগুলির স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার তাঁহার বিলক্ষণ আছে। ঔদ্ধত্য? বিলক্ষণ। কিন্তু, কথাগুলি মুখ ফুটিয়া বলিয়া ফেলা ছাড়া আর কিছুতেই তিনি প্রথম নহেন। তাঁহার সর্বাধিনায়িকাও এই ‘মালিকানা’তেই বিশ্বাসী। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ভূতপূর্ব অধীশ্বর অনিল বিশ্বাসও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সম্বন্ধে অন্য কিছু ভাবিতেন বলিয়া বিশ্বাস করিবার কারণ নাই।

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্বাস, তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে টাকা দেন। অতএব, প্রতিষ্ঠানগুলির স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার তাঁহার বিলক্ষণ আছে। ঔদ্ধত্য? বিলক্ষণ। কিন্তু, কথাগুলি মুখ ফুটিয়া বলিয়া ফেলা ছাড়া আর কিছুতেই তিনি প্রথম নহেন। তাঁহার সর্বাধিনায়িকাও এই ‘মালিকানা’তেই বিশ্বাসী। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ভূতপূর্ব অধীশ্বর অনিল বিশ্বাসও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সম্বন্ধে অন্য কিছু ভাবিতেন বলিয়া বিশ্বাস করিবার কারণ নাই। কপিল সিব্বল ভাবেন নাই, স্মৃতি ইরানিও ভাবেন না। এই ঔদ্ধত্য শাসকের ধর্ম। তবে পার্থবাবুরা, সম্ভবত স্বেচ্ছায়, বিস্মৃত হন যে সরকারের টাকা এবং নিজেদের ব্যক্তিগত টাকায় ফারাক আছে। মন্ত্রিত্ব তাঁহাদের সরকারি টাকার অছি করিয়াছে, মালিক করে নাই। অতএব, যেখানেই সরকার টাকা খরচ করিবে, সেখানেই মন্ত্রিবরের দখলদারির অধিকার গজায় না। কথাগুলি পার্থবাবু বা তাঁহার নেত্রী জানেন না, বিশ্বাস হয় না। আসলে তাঁহারা কথাগুলি জানিয়াও বিশ্বাস করিতে পারেন না। গণতন্ত্র তাঁহাদের মন্ত্রী করিয়াছে বটে, কিন্তু নিজেদের মনে তাঁহারা রাজা। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁহারা যে জনগণের অর্থের অছিমাত্র, তাঁহারা বিশ্বাসই করিতে পারেন না। সোনালি গুহ যেমন ঘোষণা করিয়াছিলেন, তিনিই সরকার, অন্যদের মনও সেই কথাই বলে। অতএব, তাঁহারা ভাবিতেই পারেন না, তাঁহাদের খাসতালুকে, তাঁহাদেরই সরকারের টাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় চলে, সেখানে ছড়ি ঘুরাইবার অধিকার তাঁহাদের নাই। পার্থবাবু মনের কথাটি মুখে আনিয়া ফেলিয়াছেন। হয়তো, সরলমতি বলিয়াই।

অথবা, হয়তো এত দিনে কথাটি উচ্চারণ করিবার সময় আসিয়াছে। শিক্ষামন্ত্রী যে দিন জানাইলেন, তিনি প্রয়োজনে শত বার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করিবেন, তাহার দুই দিন পূর্বে কলিকাতা পুরসভা সহ রাজ্যের ৯২টি নগরপালিকার নির্বাচনের ফল জানা গিয়াছিল। কী ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস এমন বিপুল জনাদেশ পাইল, তাহা লইয়া তর্ক আছে, থাকিবেও— কিন্তু জয়ের অধিক মনোবলবর্ধক দাওয়াই নাই। যে কোনও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব খর্ব করিবার যে রাজনৈতিক খেলাটি তাঁহারা খেলিতেছেন, ভোটের ফলাফলে বলীয়ান হইয়া তাহারই পরের ধাপে পা রাখিলেন পার্থবাবু। অনিল বিশ্বাসের পাঠশালায় তাঁহারা দখলদারির মহিমা শিখিয়াছেন। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট তবু রাখঢাক করিত। সেই চক্ষুলজ্জাটিও ঝাড়িয়া ফেলিবার মধ্যে বলিষ্ঠতার বিজ্ঞাপন আছে, অস্বীকার করিবার উপায় কী? তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে যে দল ভিন্ন আর কিছুরই গুরুত্ব নাই, সম্মান নাই, পার্থবাবু হয়তো এই বার্তাটিই তাঁহার দলের কর্মী-সমর্থকদের দিলেন।

কেহ অনুমান করিতেই পারেন, বার্তাটি গভীরতর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষিত ‘এলিট’দের প্রতি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজের এক ধরনের অবজ্ঞামিশ্রিত অশ্রদ্ধা আছে, তাহা স্পষ্ট। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের সাম্প্রতিক রাজনীতির মধ্যে সেই ‘এলিট’ পরিসরে রাজনৈতিক সমাজের দখলদারি প্রতিষ্ঠার চেষ্টাটি প্রকট ছিল। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করিবার অধিকারের কথা ঘোষণার ঔদ্ধত্যের মধ্যে এই রাজনৈতিক সমাজকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা ছিল। যে প্রতিষ্ঠানগুলি একদা ধরাছোঁওয়ার বাহিরে ছিল, সেগুলিকেও যে শুধু ভোটের জোরে পদানত করিয়া ফেলা যায়, এই বার্তাটি রাজনৈতিক সমাজের নিকট একটি অজেয় দ্বীপ দখলের অনুভূতি বহিয়া আনিতে পারে। রাজনীতির অঙ্কে তাহার তাৎপর্য কী, পার্থবাবুরা বিলক্ষণ জানিবেন। অতএব, জবরদখল ও ঔদ্ধত্য দীর্ঘজীবী হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE