মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা সম্প্রতি সংবাদের শিরোনামে। মঙ্গলগ্রহে তরল জল বিদ্যমান এমত তথ্য পরিবেশন করিয়া সংস্থাটি বহুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। মার্স রিকনিস্যান্স অরবিটার (এমআরও) নামক যে মহাকাশযান নয় বৎসর যাবৎ লালগ্রহের আকাশে আবর্তনশীল, তাহার যন্ত্রে শনাক্ত সংকেত অনুযায়ী, ওই গ্রহের উপরিতলে কোনও কোনও স্থানে জলমিশ্রিত খনিজপদার্থ আছে। এমআরও-র ক্যামেরা দেখিয়াছে লালগ্রহের বুকে বেশ কিছু নালার বর্ণ ঋতুভেদে বদলায়। মঙ্গলে যখন তাপমান মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তখন নালাগুলি বর্ণহীন। গ্রীষ্মকালে উষ্ণতা মাইনাস ২৩ ডিগ্রির উপরে পৌঁছাইলে দূরাকাশ হইতে নালাগুলি কৃষ্ণবর্ণ দেখায়। গবেষকদের মতে, গ্রীষ্মকালে নালাগুলি তরল জল বহন করে। মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরেই তরল জল? নাসা-র গবেষকরা ‘নেচার জিও সায়েন্স’ পত্রিকায় ব্যাখ্যা দিয়াছেন: লবণাক্ত খনিজ পদার্থের সঙ্গে মিশ্রণের ফলে জল অনেক কম উষ্ণতায় কঠিন হইতে তরলে রূপান্তরিত হয়।
প্রাক্তন মহাকাশচারী এবং বর্তমানে নাসা-র সায়েন্স মিশন ডিরেক্টরেট-এর সহযোগী প্রশাসক জন গ্রান্সফেল্ড বলিয়াছেন, সাম্প্রতিক আবিষ্কার এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, কেননা, মঙ্গলে জল থাকার ব্যাপারে গবেষকদের পুরাতন অনুমান ইহাতে সমর্থিত হইতেছে। গ্রান্সফেল্ডের দাবি প্রণিধানযোগ্য। তবে ওই সূত্রে তিনি আরও যে ইঙ্গিত দিয়াছেন, তাহা কত দূর গ্রাহ্য, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। তাঁহার মতে, মঙ্গলে অধুনা অনুসন্ধানের অভিমুখ ‘জলের পশ্চাদ্ধাবন’, কারণ তাহা ব্রহ্মাণ্ডের অন্যত্র প্রাণ অন্বেষণের মহা উদ্যোগের অংশ। এই দাবি শুনিয়া মনে পড়ে ঊনবিংশ শতকের ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিয়োভান্নি শিয়াপারেল্লি-র কথা। ১৮৭৭ সালে তিনি দুরবিনে মঙ্গল দেখিয়া প্রচুর ‘কানালি’ বা খাঁড়ি আবিষ্কার করেন। ওইগুলিকে মঙ্গলে বসবাসকারী জীবেদের খননকৃত নালা অনুমান করিয়া তিনি ইহাও দাবি করেন যে, মঙ্গলবাসীরা কৃষিকাজে লিপ্ত। অর্থাৎ, লালগ্রহ উন্নত জীবের বাসভূমি। কৃষিকাজে জল সিঞ্চনের প্রযুক্তি যাহাদের করায়ত্ত, তাহারা বুদ্ধিমান জীব ছাড়া আর কী? শিয়াপারেল্লি-র দাবি যে কল্পনাবিলাস, তাহা অচিরে প্রমাণিত হয়।
মঙ্গলগ্রহের ‘ট্র্যাজিক প্ল্যানেট’ তকমা অযৌক্তিক নহে। একদা উষ্ণ এবং সুজলা ওই গ্রহ আজ শীতল এবং শুষ্ক। বিশেষজ্ঞদের মতে মঙ্গল নাকি পৃথিবীর ভবিষ্যতের চেহারা। পৃথিবীসম একটি গ্রহে প্রাণের স্পন্দন অন্বেষণ, সুতরাং, উপযুক্ত কাজ। সমস্যাও অন্যত্র। কোথাও জলের সন্ধান মিলিলেই কি সেই স্থলে প্রাণ থাকিবার সম্ভাবনা মানা যায়? জলের পশ্চাদ্ধাবন কি ব্রহ্মাণ্ডের প্রাণ অন্বেষণের সমার্থক? ঠিকই, প্রাণের টিকিয়া থাকিবার মূলে তরল জল এক দামি উপাদান। জীবদেহে প্রোটিন একটি মূল্যবান রাসায়নিক পদার্থ। খাদ্য হইতে এনার্জি নিষ্কাশন, রক্তে বা মাংসপেশিতে অক্সিজেন সরবরাহ বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু রাখিতে প্রোটিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর নিজস্ব কাজ করিতে হইলে প্রোটিনকে তরল জলের সাহায্য লইতেই হয়। তরল জল গুরুত্বপূর্ণ, তাহা না বলিলেও চলে। কিন্তু জল তো এক উপকরণ মাত্র। প্রাণ যে অতীব জটিল এক রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলাফল। তন্মধ্যে জলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হইলেও, তাহা প্রাণের উপস্থিতির গ্যারান্টি যে নহে, তাহা বলাই বাহুল্য। সুতরাং, প্রাণ অন্বেষণে শুধুমাত্র জলের পশ্চাদ্ধাবন কি যুক্তিপূর্ণ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy