বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা অত্যন্ত মূল্যবান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির এই অভিমত ষোলো আনা সত্য। এই স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করা গণতন্ত্রের অভিভাবকদের, বিশেষত সরকারি কর্তাদের অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি পদে গোপাল সুব্রহ্মণ্যমের নিয়োগে কেন্দ্রীয় সরকার আপত্তি জানানোর ফলে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা কেন এবং কী ভাবে আহত হইল, তাহা বোঝা গেল না। বিচারপতি নিয়োগের ভারপ্রাপ্ত বিচারবিভাগীয় কলেজিয়ামের সুপারিশ পুনর্বিবেচনার জন্য প্রত্যর্পণের অধিকার সরকারের আছে, সরকার তাহা প্রয়োগ করিয়াছে। কলেজিয়াম ইচ্ছা করিলে সরকারি আপত্তি নাকচ করিতে পারিত, সে ক্ষেত্রে বর্তমান নিয়মে আপত্তি টিকিত না। সুব্রহ্মণ্যম নিজের নাম প্রত্যাহার করার ফলে সেই সম্ভাবনা আর নাই, কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। বিচারপতি নিয়োগের অধিকারপ্রাপ্ত কলেজিয়াম যে চার জনের নাম সুপারিশ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কেবল সুব্রহ্মণ্যম সম্পর্কেই সরকারের আপত্তি, সুতরাং তাঁহার নামটিকেই ‘আলাদা’ করা হইয়াছে, ইহাই কি স্বাভাবিক নহে? কেন আপত্তি, তাহা লইয়া নানাবিধ মত বাতাসে ভাসিতেছে, কিন্তু সেই বাতাসে যুক্তি ও ন্যায় নিশ্চয়ই কিছুমাত্র টলিবে না।
বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নে বিচারবিভাগ ও প্রশাসনের টানাপড়েনের বিষয়টি যে ভাবে প্রকাশ হইয়াছে, তাহাতে প্রধান বিচারপতি ক্ষুব্ধ। ক্ষোভ অহেতুক নহে। এই ধরনের বিষয় সতর্ক ভাবে ও মর্যাদা সহকারে বিবেচিত হইবে, তাহাই প্রত্যাশিত। কিন্তু মনে করিবার কারণ আছে, এ ক্ষেত্রে গোপাল সুব্রহ্মণ্যম নিজেও যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দেন নাই। প্রধান বিচারপতির প্রতিক্রিয়াও সম্ভবত তাহাই বলিতেছে। সুতরাং সতর্কতা কেবল প্রশাসন নয়, সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষেরই পালনীয়। বস্তুত, প্রধান বিচারপতির প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াই এই প্রশ্ন তোলা বোধহয় অসংগত হইবে না যে, সরকারি আপত্তির প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ায় তিনি নিজেও এ ক্ষেত্রে কিঞ্চিত্ অতিরিক্ত তীব্রতা প্রদর্শন করেন নাই কি? বিচারবিভাগের অভ্রংলিহ মর্যাদার স্বার্থেই কি বিচারপতিদের অ-স্বাভাবিক অশ্রুত এবং অপ্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়?
এহ বাহ্য। বিচারপতিরাই বিচারপতি নিয়োগ করিবেন এই রীতির ফলেই কি এই ধরনের টানাপড়েন, অসংগতি এবং সংবাদ ‘ফাঁস’-এর প্রবণতা বাড়ে নাই? বিচারবিভাগের স্বাধীনতার মূল্য প্রশ্নাতীত। সেই স্বাধীনতা অস্বীকারের পরিণাম কী হইতে পারে, দক্ষিণ এশিয়া সহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই তাহার চলমান প্রদর্শনী। সত্তরের দশকের ভারতও তাহার সাক্ষী ইন্দিরা গাঁধীর ‘দায়বদ্ধ বিচারবিভাগ’ ভারতীয় গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করিয়াছিল। সেই অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লইয়াই দেশে বিচারপতি নিয়োগে প্রশাসনের ভূমিকা লাঘব করিয়া বিচারবিভাগের অধিকার প্রায় নিরঙ্কুশ করা হইয়াছে। কিন্তু এই পদ্ধতি এক বিপরীত প্রশ্ন তুলিয়াছে। বিচারপতি নিয়োগে বিচারবিভাগই একমাত্র অধিকারী হইলে কি নিয়োগপদ্ধতি অস্বচ্ছ হইয়া পড়ে না? অস্বচ্ছতা কি পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা সৃষ্টি করে না? এই প্রেক্ষিতেই নিয়োগপদ্ধতিটি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। এই বিষয়ে পূর্ববর্তী সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু করিয়াছিল, বর্তমান সরকারের কর্তব্য সেই উদ্যোগ সম্পন্ন করা। বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতি তথা বিচারবিভাগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গুরুত্ব ও সর্বময় কর্তৃত্ব এক নহে, এবং কোনও বিষয়েই কাহারও সর্বময় কর্তৃত্ব গণতন্ত্রের অনুকূল নহে। গোপাল সুব্রহ্মণ্যমের নিয়োগ উপলক্ষে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ব্যাধির লক্ষণ। এই লক্ষণ যদি ব্যাধির চিকিত্সা ত্বরান্বিত করে, ভারতীয় গণতন্ত্রের মঙ্গল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy