Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

ডাক্তাররা সমাজেরই সন্তান

উন্নতির দুর্নিবার রথের চাকায় মানবিক স্বপ্ন দেখার জলহাওয়া পিষ্ট হয়ে গেলে তো নব্য প্রজন্ম স্বপ্নহীন, দায়হীন হয়েই পড়ে থাকবে।অভিজিৎ চৌধুরীর (‘মে ধা থাকলেই ভাল ডাক্তার হয় না’, ১৬-৬) উপমা ও ভাষার ব্যবহার চোখ টানে, একই সঙ্গে চোখ টানে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা এড়িয়ে যাওয়াটাও। তবে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পাঠরত বা সদ্য পাশ করে বেরোনো ‘নব্য’ ডাক্তারদের সামগ্রিক মনোভাব যথাযথ ভাবেই লেখাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। তাই বিপরীতে দাঁড়িয়ে পাল্টা আক্রমণ নয়, এ লেখার উদ্দেশ্য অভিজিৎবাবুর বক্তব্যের একটা অন্য দিগ্‌নির্দেশের চেষ্টা মাত্র।

অনীক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

অভিজিৎ চৌধুরীর (‘মে ধা থাকলেই ভাল ডাক্তার হয় না’, ১৬-৬) উপমা ও ভাষার ব্যবহার চোখ টানে, একই সঙ্গে চোখ টানে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা এড়িয়ে যাওয়াটাও। তবে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পাঠরত বা সদ্য পাশ করে বেরোনো ‘নব্য’ ডাক্তারদের সামগ্রিক মনোভাব যথাযথ ভাবেই লেখাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। তাই বিপরীতে দাঁড়িয়ে পাল্টা আক্রমণ নয়, এ লেখার উদ্দেশ্য অভিজিৎবাবুর বক্তব্যের একটা অন্য দিগ্‌নির্দেশের চেষ্টা মাত্র।
বক্তব্যের প্রথমাংশ জুড়ে ‘মেধাবী’ ছেলেমেয়েরা মূলত প্রতিপত্তি ও টাকপয়সার জন্যই ডাক্তারি পড়তে আসছেন, এ ছবিই তুলে ধরা হয়েছে। সমাজ, তার চাহিদা, তার ‘কেরিয়ার মূল্যায়ন’ উচ্চ মাধ্যমিকের ঘাট পেরিয়ে আসা এক জন ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনে যে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে তার উল্লেখ প্রয়োজনীয় নয় কি? যে ছেলেটা দশ বছর ধরে টিভির সামনে বসে স্টেটাস-এর সংজ্ঞা গিলল, যে মেয়েটা খবরের কাগজ হাতে ক্লাস ফোর থেকে উন্নতির মেগা সিরিয়াল দেখল, সে কোন জাদুবলে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেয়ে জয়েন্ট না দিয়ে নিজের পছন্দের অন্য কোনও বিষয়কে গভীরে জানার জন্য অনার্স পড়বে? ‘মেধা’র সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক চলুক, কিন্তু শিক্ষার যে মূল্যায়ন ব্যবস্থা এক জনকে ‘মেধাবী’ তকমা দিচ্ছে, তাকে যদি আমরা শেষ পর্যন্ত মেনেই নিই, তা হলে কোন যুক্তিতে এক জন মেধাবী ডাক্তারি পড়াকে নিজের মকসদ বানাবে না? আমাদের সমাজে এক জন স্কুলপড়ুয়ার নিজের ব্যুৎপত্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী ‘কেরিয়ার’ নির্বাচনের কোনও ধারণা বর্তমান আছে কি? আর হলফ করে বলতে পারি, প্রতিপত্তি ও টাকার হিসেব অবচেতনে রেখেও যদি একশোটা ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়তে ঢোকে, তার মধ্যে আজও অন্তত জনা ষাটেক ‘মানুষের সেবা করব’, এই ইচ্ছা নিয়েই ডাক্তারি পড়তে ঢুকছে।

বক্তব্যের দ্বিতীয়াংশে এসে নব্য প্রজন্মের ডাক্তারদের আখ্যানে ফুটে উঠেছে হিপোক্রেটিক শপথ আওড়ানো ‘হিপোক্রিট’দের কথা। আমি একমত। কিন্তু অভিজিৎবাবু যে ‘সত্তর, আশি এমনকী নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক ন্যায়ের ভাবনায় সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা’ দেখতে পাওয়ার কথা বলছেন তার প্রেক্ষিত সে সময়ের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। সমাজে সুস্থ ও উন্নত রাজনীতির পরিসর থাকবে না, আর মেডিক্যাল কলেজে এক জন পড়তে এসে টপাটপ ‘আর্তমানুষের সেবা’র উদ্দেশ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে? আর্থসামাজিক কাঠামো, তাতে ডাক্তারের অবস্থান, দায়, ভূমিকা ও কর্তব্যবোধ গঠনের জন্য যে ন্যূনতম রাজনৈতিক পরিমণ্ডল লাগে, বোধের বিকাশের যে ক্ষেত্র লাগে, সেটা ধ্বংস করেছে ও করছে পূর্বতন থেকে বর্তমান শাসকশ্রেণি ও তার রাজনীতিই। আজ যিনি ডাক্তারি পড়তে এসে সাড়ে পাঁচ বছরে এক বারও এই কথাটাই শুনলেন না যে, এ দেশে প্রতি সতেরোশো জন মানুষ পিছু এক জন ডাক্তার— যে ডাক্তারদের আবার দুই-তৃতীয়াংশই শহরে— তিনি কোন মন্ত্রবলে দীক্ষিত হয়ে ডাক্তারি পড়ে উঠে গ্রামে যাবেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য?

আইকিউ মেপে শুভবোধের ধারণা পাওয়া যায় না, কিন্তু কী ভাবে শুভবোধ জাগ্রত হয়, অন্তত তার বাতাবরণটা তৈরি হয়। ওটা আকাশ থেকে পড়ে না, বোঝাপড়ার যে পরিমণ্ডলে ওটা তৈরি হয় (আমি তাকে ‘ছাত্র রাজনীতি’ই বলব), তাকে সমাজের সমস্ত প্রাজ্ঞ ও পুরোনো হোতারা দেওয়ালে গজাল মেরে গেঁথে শপিং মলে মাসকাবারি করতে বেরিয়েছেন, আর খেয়াল পড়লে নব্য প্রজন্মকে গালে ঠোনা মেরে ‘দুষ্টু কোথাকার’ বলে দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির দুর্নিবার রথের চাকায় মানবিক স্বপ্ন দেখার জলহাওয়া পিষ্ট হয়ে গেলে তো নব্য প্রজন্ম স্বপ্নহীন, দায়হীন হয়েই পড়ে থাকবে এ পৃথিবীর যুদ্ধক্ষেত্রে— এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! ডাক্তার তো ভিনগ্রহবাসী নয়, না?

বক্তব্যের প্রায় শেষাংশে এক বার মাত্র লেখক ‘মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষণ পরিমণ্ডলের’ উল্লেখ করেছেন। তার খানিক পরে ‘পোল্ট্রি’র মুরগিদের সহবত শিখিয়েছেন, কী ভাবে ‘জ্ঞানের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে আর তার প্রায়োগিক ব্যুৎপত্তিতে দক্ষ হয়ে মানুষের মাঝে বেরিয়ে পড়া’ যায়। গোটা মেডিক্যাল পড়াশুনোয় চারটে ‘এম বি’ মিলিয়ে মোট চোদ্দোটা বিষয় পড়ানো হয়, যার মধ্যে আটখানাই ‘নন-ক্লিনিকাল’। খুব কম শিক্ষকশিক্ষিকাই এমন ভাবে সেগুলো পড়ান যাতে মানুষের জীবন, তার শরীর, তার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় এই বিষয়গুলোর ভূমিকা সম্বন্ধে আগ্রহ জন্মায়। সিলেবাস আর পরীক্ষা ব্যবস্থা এমন ভাবে তৈরি, যাতে আগ্রহ ব্যপারটাকে বাড়িতে রেখে ক্লাসে আসতে হয় ডাক্তারি পড়ুয়াদের। এক জন ডাক্তারি পড়ুয়া রোগের উপসর্গ শিখছে, কোষীয় ও আণবিক স্তরে তার কারণ জানছে, নির্দিষ্ট ওষুধ কী ভাবে কাজ করে তা মুখস্থ করছে, কিন্তু কোনও রোগীকে ছুঁয়েও দেখছে না, তার সঙ্গে কথা বলাই শিখছে না— এর থেকে অবৈজ্ঞানিক আর কী হতে পারে? এই মুহূর্তে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের এক একটা ব্যাচে দুশো-আড়াইশো ছাত্রছাত্রী, তারা কী ভাবে শবদেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে ব্যবচ্ছেদ করা শিখছে, ওয়ার্ডে ঘুরে এক জন রোগীকে ঘিরে ধরে জনা পঞ্চাশ মিলে ‘কেস স্টাডি’ শিখছে, তার উল্লেখও জরুরি। আর, ডাক্তারি গুরুমুখী বিদ্যা। একটা রোগ সম্বন্ধে আগাপাশতলা জানতে হয়, সেটা নিরাময়ের পদ্ধতি নিখুঁত ভাবে শিখতে হয়, যেন প্রয়োগক্ষেত্রে ভুল না রয়ে যায়। আজ ক’জন স্যর বা ম্যাডাম ধৈর্য ধরে পড়ে থাকছেন ওয়ার্ডগুলোতে সেই বিদ্যা শেখানোর জন্য?

ডাক্তারি পড়াশোনায় প্রচণ্ড দড় হয়ে পাশ করা ছাত্রটিও ঘরোয়া পদ্ধতিতে ওআরএস বানাতে জানে না, আমাদের এই গরিব দেশে অত্যাধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওষুধের বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিপূর্ণ ব্যবহার, কোন পরীক্ষা কখন করাব, তার বাস্তবসম্মত ধারণাও অস্পষ্ট। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই জন্যই যে সে ডাক্তারি পাশ করেই ছুটবে কোনও একটা বিশেষ বিষয়ে স্পেশালিস্ট হওয়ার জন্য, তাতে আর আশ্চর্যের কী? আর স্পেশালিস্ট হওয়ার সেই অমানুষিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও তাকে জিজ্ঞেস করা হবে প্রতি দশ লক্ষ মানুষে এক জনের হয় সেই রোগ ও তার সঙ্গে জড়িত হাজারটা প্রশ্ন। আর সত্যি করে বলুন তো, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল বাদ দিলে আজ ক’টা মানুষ নামের পাশে শুধু এমবিবিএস বসানো কারও কাছে চিকিৎসা নিতে আসছে? তাই সর্ব অর্থেই এই মুহূর্তে ডাক্তারি পাশ করা এক জন বিশেষজ্ঞ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত অসহায়।

একই সঙ্গে, নব্য ডাক্তারদেরও ভেবে দেখতে বলব, এপ্রনের পকেটে, স্টেথোর চেস্টপিসে, স্ফিগমোম্যানোমিটারের পারদস্তম্ভে কোন আদর্শ আর মানসিকতা বহন করছি আমরা। অর্থনৈতিক ভাবে নেতিয়ে না পড়েও দিনের শেষে ‘মানুষের জন্য’ ডাক্তারিটা করাই যায়।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে কর্মরত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE