কোপের মুখে। একশো দিনের কাজ। পরানগঞ্জ, বর্ধমান।
ই উপিএ আমলের কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন আর তথ্য-অধিকার আইন, নয়া জমানায় দু’টিই প্রায় অচল হয়ে গেছে। সরকার কি চিরকালই আমাদের মাটি কাটার কাজ জোগাবে? তা হয় না। নতুন সরকার চাইছে আমাদের ছেলেমেয়েরা কাজ করবে অত্যাধুনিক শিল্পে। এখন আর শুধু কল-সেন্টার নয়, দেশে এ বার রাফেল জেট বিমান তৈরি হবে, যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার, বন্দুক-কামান গোলাগুলি— যা আমরা এত দিন বিদেশ থেকে আমদানি করেছি, তা এ বার দেশেই তৈরি করব। এ কাজ আগেই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু পরিকাঠামোর দিকে আমরা তেমন নজর দিইনি, তাই উৎপাদন শিল্পে বিদেশি লগ্নি আসেনি। এখন সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্কিল থাকলেই চাকরি। এ সুযোগ পেলে কে-ই বা মাটি কাটবে আর কে-ই বা এনজিও চালিয়ে বিডিও সাহেবের পিছনে ছুটবে তথ্য জোগাড় করতে?
প্রধানমন্ত্রী সংসদকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তাঁর সরকার এনরেগা (জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প) তুলে দেবে না। আর কিছু না হোক, কংগ্রেসের পঞ্চাশ বছরের রাজত্বের পরেও দেশের লোককে মাটি কাটতে হচ্ছে, তা দেখাবার জন্যেই তাঁরা এনরেগা চালিয়ে যাবেন। সরকার কিন্তু এই কাজের টাকার জোগান এত কমিয়েছেন যে কাজকর্ম বন্ধ হবার উপক্রম। বেশির ভাগ জেলায় গত বছরে যে কাজ হয়েছে, তার মজুরিও পাওয়া যায়নি। সরকার এক বার বলল, এই কাজ কিছু বিশেষ জেলায় সীমাবদ্ধ রাখবেন, যেমন আদিবাসী অধ্যুষিত জেলায়। তা হলে হয়তো মন্দের ভাল হত, কিন্তু এমনই প্রতিবাদ হল যে সরকার পিছু হটলেন। ফলে এখন আর কোথাও কাজ ঠিক মতো হচ্ছে না। ভারত সরকার হয়তো বলতে পারেন যে, রাজ্যের হাতে এখন অনেক বেশি পয়সা, প্রয়োজন হলে এ কাজ তাঁরাও চালাতে পারেন। সরকার কিন্তু এই কাজে বরাদ্দ বাড়িয়ে যদি রাজ্যগুলিকে কম টাকা দিতেন, তা হলে কেউ আপত্তি করত না। আসলে এই প্রকল্পের উপর সরকারের আস্থা নেই।
একটা কথা বরাবর শোনা গেছে: এনরেগা-র কোনও স্থায়ী সম্পদ তৈরি হয়নি, যা গরিব মানুষের জীবিকা উপার্জনে কাজে লাগে। এ সমস্যা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এর সমাধান নেই তা নয়। আমাদের রাজ্যেই অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে এনরেগার সঙ্গে অন্য বিভাগীয় স্কিম জুড়ে নিয়ে চাষের কাজ হচ্ছে, মাছ চাষ হচ্ছে, তসরের গুটিপোকা তৈরি হচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁকরাইলে, কোদোপাল গ্রামে ডুলুং নদীর একটা চারশো একরের চর আছে। এনরেগার টাকায় এই চরের দু’শো একর জমি চাষযোগ্য করা হয়েছে। কৃষি দফতর এবং হর্টিকালচার দফতরের সাহায্যে স্থানীয় গরিব মানুষ সেই জমি চাষ করছেন। দুর্গম জায়গা, সেচের অভাব, হাতির উপদ্রব ইত্যাদি কারণে ওই চরে আগে কোনও দিন চাষ হয়নি। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।
এই কাজের টাকা বাঁচিয়ে আমরা বিমান আর কামান বানাব, সেগুলি কি স্থায়ী সম্পদ হবে? উৎপাদনকারী সম্পদ হবে? গরিব মানুষের কাজে লাগবে? না কি সেই উন্নয়ন বাজেট ছাঁটাই করেই গোলাগুলি কেনার টাকা বার করতে হবে? দেশের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি হইচই করলে বিদেশি লগ্নি পেতে অসুবিধা হবে না? অবশ্য উৎকৃষ্ট প্রযুক্তি পাওয়া গেলে উৎপাদনের অনেকটাই রফতানি করা যাবে। আমাদের পাড়াপড়শিরা না কিনলেই হল।
নানা প্রশ্নের উত্তর জানা অধিকার। এই প্রেক্ষিতেই তথ্য অধিকার আইনের গুরুত্ব। এই আইনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে, পি ভি নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। আমলারা একেবারেই নিরুৎসাহ, তাই কাজ খুব এগোয়নি। ২০০৪ সালে প্রথম ইউপিএ সরকার আসার পরে যে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়, সেই কমিটির সদস্যদের উদ্যোগে এবং সনিয়া গাঁধীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই আইন পাশ হয়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ গরিব মানুষ জানেন তাঁদের জন্য সরকার কী পরিকল্পনা নিয়েছেন, কোন স্কিম অনুযায়ী তাঁদের কী পাওনা। আশা ছিল যে তাঁরা এই আইন ব্যবহার করে প্রকৃত তথ্য জানবেন এবং সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণের ভাগীদার হবেন। যেখানে মানুষ এনজিও-দের সাহায্য পেয়েছেন, সেখানে এই আইন সত্যিই তাঁদের কাজে লেগেছে। যেমন, রাজস্থানে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে অরুণা রায়ের সংগঠন।
আমলাদের আপত্তি ছিল খুবই স্বাভাবিক। তাঁরা যে-যার জায়গায় যতটুকু সম্ভব কাজ করেছেন দেশের ও দশের জন্যে। গরিব দেশ, সরকারি ক্ষমতা সীমিত, এর চেয়ে ভাল পরিষেবা পাওয়া অসম্ভব— এই সহজ সত্যি কথাটা মেনে নেওয়া যায় না? যিনি রোজ আটটা পর্যন্ত পরিশ্রম করেন, তাঁকে এ বার ন’টা পর্যন্ত থেকে হিসেব করতে হবে কোন কাজ হয়নি আর কেন হয়নি। রবীন্দ্রনাথের লেখায় পড়েছি, জোড়াসাঁকোয় এক ভৃত্যের মৃত্যুর পর তাকে প্ল্যানচেটে ধরা হয়। প্রশ্ন করা হয়, ‘কীরে তুই কেমন আছিস? যেখানে আছিস, সেই জায়গাটা কী রকম?’ উত্তরে সে বলে, ‘বাবু, তা বলা যাবে না। যে কথা জানতে আমায় মরতে হয়েছে, সেই কথা আপনারা কলকাতায় বসে জানতে পারবেন, তাই কি হয়?’ হয়তো উপাধিধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যদের মনেও এ কথা ছিল। সরকারের গতিপ্রকৃতি ও ভাবনাচিন্তা জানার জন্য আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা কাটাতে হয় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। বাইরের একটা লোক দশ টাকা দিয়ে দরখাস্ত করবে আর তাকে সব কথা বলে দিতে হবে?
আইন পাশ হবার পরে অবশ্য আমলারা বুঝতে পারেন যে তাঁরাই উপকৃত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। আমার প্রমোশন অথবা পোস্টিং কেন হল না, কেন হল, কবে হবে— সব প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া গেল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি চিরকালই এই আইনের বিরুদ্ধে। পলিথিনের লিস্টিতে মুন্নির নাম নেই কেন, এ ধরনের প্রশ্ন সব সময়ই অস্বস্তিকর। আর তথ্য কমিশন যখন বললেন রাজনৈতিক দলগুলিও এই আইনের আওতায় পড়ে, নেতারা সেই কথা কানেই নিলেন না।
নয়া সরকার আসার পরে এক বছরে নয় মাস কেন্দ্রীয় কমিশনের প্রধানের পদ খালি পড়ে রইল। এখন নতুন প্রধান নিযুক্ত হচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে, কমিশনের আর্থিক বরাদ্দে কাটছাঁট হচ্ছে এবং আর্থিক ক্ষমতা কমিশনের হাত থেকে নিয়ে দেওয়া হচ্ছে সচিবকে। এগুলি কিন্তু সামান্য ঘটনা। বড় ব্যাপার হল এই যে, সরকার বিনিয়োগের স্বার্থে মানুষের প্রশ্ন করার অধিকার মুলতুবি রাখতে চাইছেন। প্রশ্নই যদি না করা গেল, তথ্য নিয়ে মানুষ করবে কী, আর রাখবে কোথায়? তথ্য আইনের যারা প্রধান সৈনিক, সেই এনজিও-রাই এখন প্রশ্নের মুখে। সরকারের কোন সমালোচনায় আর্থিক বৃদ্ধির হার ক’টা কমল, সেই হিসেব রাখছে পুলিশ, যাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী যেখানে দেশের মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন, সেখানে কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ— মন্ত্রী, আমলা, এনজিও যে-ই হোক— বাঞ্ছনীয় নয়। দেখলাম, নবনিযুক্ত প্রধান তথ্য কমিশনার এক সাংবাদিককে বলেছেন, তিনি অগ্রাধিকার দিয়ে ‘বিরক্তিকর’, ‘আপত্তিকর’ এবং ‘হাস্যকর’ আবেদনগুলিকে ছেঁটে বাদ দেবেন। সে-ই ভাল। আপাতত এর বেশি কিছু করা উচিত হবে না।
ভূতপূর্ব মুখ্য সচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy