Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

তপস্যা

এক বৎসর পূর্বে একটি মন্দিরে এক পবিত্র শপথ গ্রহণ তাঁহার কর্তব্য ছিল। মন্দিরটি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের। জিডিপি নামক দেবীর সম্মুখে শপথ করা উচিত ছিল, বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্র হইতে ভারতের যে আখ্যানটি বিলীয়মান, তিনি তাহাকে ফিরাইয়া আনিবেন। ২০১৪ সালের মে মাস নরেন্দ্র মোদীর অনুকূলে গোটা দেশের যে সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছিল, তাহার প্রাণকেন্দ্রে ছিল এই শপথের প্রত্যাশা।

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০০:৪২
Share: Save:

এক বৎসর পূর্বে একটি মন্দিরে এক পবিত্র শপথ গ্রহণ তাঁহার কর্তব্য ছিল। মন্দিরটি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের। জিডিপি নামক দেবীর সম্মুখে শপথ করা উচিত ছিল, বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্র হইতে ভারতের যে আখ্যানটি বিলীয়মান, তিনি তাহাকে ফিরাইয়া আনিবেন। ২০১৪ সালের মে মাস নরেন্দ্র মোদীর অনুকূলে গোটা দেশের যে সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছিল, তাহার প্রাণকেন্দ্রে ছিল এই শপথের প্রত্যাশা। ভারত তাঁহার নিকট পরিবর্তন প্রত্যাশা করিয়াছিল। ‘ঝোলাওয়ালা’ রাজনীতির ঘোলা জলে হারাইয়া যাওয়া আর্থিক বৃদ্ধির স্বপ্নের নূতন উড়ান চাহিয়াছিল। প্রত্যাশা ছিল, জিডিপি-র বৃদ্ধির হারই হইবে তাঁহার পাখির চোখ। তাঁহার চোখ অন্য কিছু দেখিবে না, তাঁহার কান অন্য শব্দ শুনিবে না, তাঁহার মন আর কিছু ভাবিবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রথম ৩৬৫ দিনের জমা-খরচের হিসাব বলিতেছে, তাঁহার মনঃসংযোগ অখণ্ড থাকে নাই। তিনি আরও পাঁচটি জিনিসে মন দিয়াছেন। তাহার সবই পণ্ডশ্রম নহে। যেমন, নিঃসন্দেহে দুর্নীতি কমিয়াছে। তাহা বিলক্ষণ কাম্য, কিন্তু বৃদ্ধির হারের সহিত সরাসরি সম্পর্কহীন। অন্য দিকে, বৃদ্ধির হারের তপস্যায় কখনও নাগপুরের অহেতুক জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়া পড়িয়াছে, কখনও অরুণ জেটলির অপরিণামদর্শিতা বিঘ্ন ঘটাইয়াছে। ভারতীয় অর্থনীতির উড়ানের গল্পটি এখনও পুনরুদ্ধারের অপেক্ষায় আছে।

বিনিয়োগই পারে সেই রূপকথাটিকে ফিরাইয়া আনিতে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র শুষ্ক স্লোগানে বিনিয়োগ ভিজিবে না। তাহার জন্য পরিবেশ চাই। গত এক বৎসরে বিনিয়োগ আসে নাই। শিল্পপতিরা প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়াছেন, কিন্তু টাকার থলির বাঁধন আলগা করেন নাই। এমন নহে যে তাঁহাদের হাতে টাকা নাই। তাঁহারা এখনও বিনিয়োগ বিষয়ে নিশ্চিত হইতে পারিতেছেন না। এই অনিশ্চয়তার দায় প্রধানমন্ত্রীর উপরই বর্তায়। ভারত যে দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারের অপেক্ষায় আছে, নরেন্দ্র মোদী গত এক বৎসরে সেই পথে হাঁটিতে পারেন নাই। অরুণ জেটলি বিপুল বিলগ্নিকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। তাহা বাস্তবায়িত হয় নাই। খুচরা বিপণনে বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমার প্রশ্নে অহেতুক বিতর্ক তৈরি হইয়াছে। নাগপুরের ‘বিদেশি ভীতি’ নয়াদিল্লির নীতিতে প্রভাব ফেলিলে সরকারের সদিচ্ছা লইয়াই প্রশ্ন তৈরি হয়। বিদেশি বিনিয়োগে মূলধনী লাভের উপর ন্যূনতম বিকল্প কর আরোপ করিবার সিদ্ধান্তটিও বিপরীতফলদায়ী। সিদ্ধান্তটি পরিণামে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জেনারেল অ্যান্টি-অ্যাভয়েড্যান্স রুলের সহিত তুলনীয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে ভীতিসঞ্চারের এমন রাস্তা আর হয় না। জিডিপি-র মন্দিরে যাঁহার তপস্যা করিবার কথা, তাঁহার আমলে এমন ঘটনা ঘটিলে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে।

জিডিপি-র তপস্যা ধর্মে নির্মম। বিচ্যুতির ক্ষমা নাই। এই তপস্যা দাবি করে, সরকার কী করিবে, আর কী করিবে না, তাহার সমস্তই নির্ধারিত হইবে বৃদ্ধির হারের ধ্রুবতারার পথনির্দেশ মানিয়া। বৃদ্ধির হারের জন্য যদি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রয়োজন হয়, একমাত্র তবেই সেই পথে হাঁটিতে হইবে। যদি উৎপাদন অপেক্ষা পরিষেবায় অধিকতর লাভ হয়, তবে ভারতে নির্মাণ প্রয়োজন নাই। যদি গঙ্গার পরিবর্তে খাল সাফ করিলে অর্থনীতির উপকার হয়, তবে গঙ্গা ছাড়িয়া খালে মনোনিবেশ করাই বিধেয়। লক্ষ্যের দাবি মানিয়া পথ বাছিতে হইবে। যে নীতি ভারতকে দ্রুত আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করিবে, তাহাই সরকারের নীতি হওয়া বিধেয়। তাহার জন্য যে পথে হাঁটা প্রয়োজন, তাহাই আদর্শ পথ। সেই পথ বাছিবার জন্য দূরদৃষ্টি প্রয়োজন, বৃহত্তর ছবিটি দেখিতে পাওয়া জরুরি। অতঃপর এই সাধনাই একমাত্র হউক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE