Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

দলিত রাজনীতি, এখন

অবশেষে বামপন্থীদের ঘুম ভাঙিয়াছে। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি আগামী নভেম্বরে দলিতদের জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন (নিখিল ভারত দলিত শোষণমুক্তি সংগঠন) গড়ার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। যাঁহারা চির কাল ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্যতা এবং নিম্নবর্গীয় জাত-পাতের উপর উচ্চবর্ণীয়দের শোষণকে শ্রেণি-বিভাজনের চশমা দিয়া দেখিয়া আসিয়াছেন এবং শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়াই তাহার সমাধানের কথা বলিয়াছেন, তাঁহারা শেষ পর্যন্ত দলিতের ক্ষমতায়নকে একটি শ্রেণি-নিরপেক্ষ বিষয় হিসাবে পর্যালোচনা করিতে প্রস্তুত।

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

অবশেষে বামপন্থীদের ঘুম ভাঙিয়াছে। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি আগামী নভেম্বরে দলিতদের জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন (নিখিল ভারত দলিত শোষণমুক্তি সংগঠন) গড়ার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। যাঁহারা চির কাল ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্যতা এবং নিম্নবর্গীয় জাত-পাতের উপর উচ্চবর্ণীয়দের শোষণকে শ্রেণি-বিভাজনের চশমা দিয়া দেখিয়া আসিয়াছেন এবং শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়াই তাহার সমাধানের কথা বলিয়াছেন, তাঁহারা শেষ পর্যন্ত দলিতের ক্ষমতায়নকে একটি শ্রেণি-নিরপেক্ষ বিষয় হিসাবে পর্যালোচনা করিতে প্রস্তুত। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন বাধ্য হইয়া। উচ্চবর্ণীয়দের মধ্যে দলের শক্তিক্ষয় বামেদের বাধ্য করিয়াছে মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা পরিহার করিয়া ভারতীয় বাস্তবতা উপলব্ধি করিতে। কেবল তাঁহাদের একটু বেশি দেরি হইয়া গিয়াছে। কেননা ইতিমধ্যে দলিতরা এমনকী তাঁহাদের নিজস্ব সংগঠনের মায়া কাটাইয়া অন্য দিকে ঝুঁকিতে শুরু করিয়াছেন।

বিহার ও উত্তরপ্রদেশের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করিলে এ বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ কম। দলিতদের নিজস্ব সংগঠন মায়াবতীর বহুজনসমাজ পার্টি যে ওই নির্বাচনে একটি আসনও দখল করিতে পারে নাই, তাহার কারণ, দলিতরা আর নিছক আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে আটকা থাকিতে চাহিতেছেন না। তাঁহারাও চাহেন অবশিষ্ট দেশের উন্নয়নযজ্ঞের সমান অংশীদার হইতে, কেবল সংরক্ষণের দাক্ষিণ্য আর সরকারি ভর্তুকির কৃপার অপেক্ষা না করিয়া সম্মুখে অগ্রসর হইতে। তাঁহাদের মধ্যে এই ভাবনা জাগাইয়াছে দলিত সম্প্রদায়েরই মধ্য শ্রেণি, গত চার দশকের সংরক্ষণ নীতির সুফল আত্মসাত্‌ করিয়া যাঁহারা এখন শিক্ষিত, চাকুরিজীবী, প্রায়শ ছোট-মাঝারি উদ্যোগপতিও। তাঁহারা উচ্চবর্ণীয়দের দয়ায় বাঁচিবার গ্লানি হইতে মুক্তি চাহেন। বিজেপি কি তাঁহাদের সেই মুক্তির পথ বাতলাইতে পারে? অন্তত বিহার-উত্তরপ্রদেশের দলিতদের এক অংশ তেমনই ভাবিতেছেন, নহিলে নরেন্দ্র মোদীর ঝুলি তাঁহারা এ ভাবে ভরিয়া দিবেন কেন? কিছু কাল আগে পর্যন্ত যে দলিত নেতা উদিত রাজ বৌদ্ধ ধর্মে দলিতদের অন্তরিত হইবার আয়োজন সংগঠিত করিতেন, তিনি বিজেপিতে যোগ দিবেন কেন? উত্তরপ্রদেশের একের পর এক সাম্প্রতিক দাঙ্গায় কেন দলিতরা মুসলিমদের উপর চড়াও হইবেন?

অন্তত উত্তর ভারতে, বিশেষত হিন্দি বলয়ে দলিতদের সহিত সংঘ পরিবারের একটা নূতন সমীকরণের প্রক্রিয়া চলিতেছে। ইতিপূর্বে বিহারের দলিত নেতা রামবিলাস পাসোয়ানকে এনডিএ-তে যোগ দিতে দেখা গিয়াছে। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা আসনগুলির উপনির্বাচনে মায়াবতীর বহুজনসমাজ পার্টি এ বার কোনও প্রার্থীই দেয় নাই। ইহাও হয়তো সেই সমীকরণের ইঙ্গিত। এই অবস্থায় বামপন্থীদের দ্বারা দলিতদের পৃথক সংগঠন গড়ার সিদ্ধান্ত বিশেষ কার্যকর হইবার নহে। বাবাসাহেব অম্বেডকর ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ধনতন্ত্র, উভয়ের বিরুদ্ধেই দলিতদের সতর্ক করিয়াছিলেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর দলিতরা অম্বেডকরের সতর্কবাণী উপেক্ষা করিতেই মনস্থ করিয়াছেন। আর্থ-সামাজিক সিঁড়ির উপরের ধাপে উঠিবার তাগিদ এখনকার দলিতদের সনাতন হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের সহিত পঙ্ক্তিভোজনে অনিচ্ছুক রাখে নাই, ধনতন্ত্রের সুযোগসুবিধা গ্রহণ করিয়া আত্মোন্নতির সোপান আরোহণেও কোনও নৈতিক বাধা সৃষ্টি করিতেছে না। মার্ক্সবাদীদের কপাল খারাপ। তাঁহারা বড় বেশি দেরি করিয়া ফেলিলেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE