Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

দুই যাদবপুর

কর্তৃপক্ষ বুঝেছেন, এই স্বাধীন মনোভাব চিন্তার স্তরে বিনষ্ট করতে পারলে আর ছাত্র পিটিয়ে বদনাম কুড়োতে হবে না, আপনিই সব পোষ মেনে যাবে। সুকান্ত চৌধুরীযাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গলবার রাতের ছবি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম দু’বছর আগে সেখানে আর একটা রাতের কথা। আড়াইটে নয় অবশ্যই, ন’টা নাগাদ। কোনও গণ্ডগোল নয়: দিনভ’র কাজের পর ষাট-সত্তর জন অধ্যাপক ছ’টা থেকে ন’টা আলোচনা করছিলেন, ইউজিসি ঘোষিত এক নতুন গবেষণা-অনুদানের কী করে সদ্ব্যবহার করা যায়।

পরিবর্তন। ভূতপূর্ব উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য ও বর্তমান (অস্থায়ী) উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তীয়

পরিবর্তন। ভূতপূর্ব উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য ও বর্তমান (অস্থায়ী) উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তীয়

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গলবার রাতের ছবি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম দু’বছর আগে সেখানে আর একটা রাতের কথা। আড়াইটে নয় অবশ্যই, ন’টা নাগাদ। কোনও গণ্ডগোল নয়: দিনভ’র কাজের পর ষাট-সত্তর জন অধ্যাপক ছ’টা থেকে ন’টা আলোচনা করছিলেন, ইউজিসি ঘোষিত এক নতুন গবেষণা-অনুদানের কী করে সদ্ব্যবহার করা যায়। নির্ভেজাল উচ্চতর গবেষণা নিয়ে এই আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তত্‌কালীন উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য। ক’মাস মাত্র যাদবপুরে এসেছেন তখন, কিন্তু তাঁর গোড়ার ভাষণ ও সভা পরিচালনা থেকে স্পষ্ট, তার মধ্যেই তিনি সাঁইত্রিশটা বিভাগ আর একুশটা স্কুল-এর গবেষণা-বৃত্তান্ত গুলে খেয়েছেন, ভবিষ্যত্‌ পদক্ষেপের একটা পরিকল্পনাও ছকে এনেছেন।

বেরিয়ে ধন্য মনে হচ্ছিল, এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি যেখানে এমন আলোচনা সম্ভব। আর ধন্যবাদ দিলাম তখনও-নতুন সরকারকে, যার তত্‌কালীন নিয়োগনীতির দৌলতে এমন উপাচার্য পাওয়া গেছে যিনি এই চর্চার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।

কিছু দিন বাদেই শৌভিকবাবু পদত্যাগ করে চলে গেলেন, ছাত্র আন্দোলনের ফলে নয়, কিছু বয়স্কের উত্‌পাত আর বাধাসৃষ্টিতে। ইতিমধ্যে সরকার উপাচার্য-নিয়োগের রীতি দু’বার বদলেছে, তার ফলে সারস্বত নেতৃত্বের নিরিখে নিয়োগের সম্ভাবনা হয়ে পড়েছে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।

পঠনপাঠনের যাদবপুর, গবেষণার যাদবপুর কিন্তু এখনও বিদ্যমান ও সক্রিয়। এই মুহূর্তে প্রাঙ্গণের যে উত্তাল অবস্থা, পাঁচ-সাত বছর বাদে-বাদে এমন এক একটা বিপর্যয় কিছু দিনের জন্য এই অন্য যাদবপুরকে একটু সঙ্কুচিত করে ফেলে, শীঘ্রই তা ফিরে যায় নিজের খাতে।

এ বার কিন্তু ভয় হচ্ছে, সেই ফিরে যাওয়ার পথে কাঁটা পড়বে। কারণ এ বার বিশ্ববিদ্যালয়কে অভ্যস্ত ছন্দে ফিরে যাওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে না। সরকার তথা উপাচার্যের স্পষ্ট বার্তা, এই বেয়াড়া বিদ্যায়তনটিকে ভালরকম শিক্ষা দিতে হবে।

অতএব ছাত্র পেটানো হচ্ছে, প্রস্তাব হচ্ছে পুলিশ পিকেট বসাবার। এ সব নিয়ে অন্তত প্রতিবাদ হয়। কিন্তু একই সঙ্গে একটা সমান্তরাল প্রক্রিয়া চলছে, যা অদৃশ্য ও অহিংস, অথচ যার বিধ্বংসী প্রভাব আরও স্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী। এর ফলে প্রচুর শিক্ষকপদ দীর্ঘদিন খালি পড়ে আছে। বহু অপরিহার্য কাজের ভিত্তি যে স্ট্যাটিউট ও অর্ডিন্যান্স, সেগুলি দীর্ঘকাল সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায়। যে আন্তর্বিষয়ক স্কুলগুলি যাদবপুরের শ্রেষ্ঠ গবেষণার একটা মস্ত অবলম্বন, সেগুলিকে অনাথ অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

তেইশ বছর আগে সরকারি কলেজের হাঁফধরা আবহাওয়া থেকে যাদবপুরে এসে উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম তার মুক্ত পরিবেশে। এর খারাপ দিক অবশ্যই ছিল: কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা, প্রচুর শৌখিন পল্লবগ্রাহিতা। কিন্তু সঙ্গে ছিল ভাল দিকটা; স্বাধীন চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ, সেগুলি কাজে পরিণত করার জন্য বেশ কিছু প্রশাসনিক স্বাচ্ছন্দ্য। যাদবপুরে যে প্রাণবন্ত বিদ্যাচর্চার পরিবেশ পেয়েছি, তার মূলে এই মুক্ত বায়ুর সঞ্চার। তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আর্ন্তবিষয়ক স্কুলগুলিতে, যার নজির ভারতে আর কোথাও নেই।

এই স্বাধীন স্বকীয় মনোভাব নিয়েই যেন কর্তৃপক্ষ সন্দিগ্ধ ও চিন্তিত। তাঁরা ঠিক ধরেছেন, এটাই নষ্টের গোড়া। চিন্তার স্তরে, রূপায়ণের স্তরে এটি বিনষ্ট করতে পারলে আর ছাত্র পিটিয়ে বদনাম কুড়োতে হবে না, আপনা-আপনিই সবাই পোষ মেনে যাবে।

শিক্ষায়তন রাজনীতির আখড়া নয়, পঠনপাঠন গবেষণার স্থান। গত ক’দিনের প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী এ কথা যাদবপুরের সদস্যদের বলেছেন। তাঁকে সভয় ও সনির্বন্ধ অনুরোধ, দয়া করে যাদবপুরকে সেই চোখে দেখুন। যদি তাকে দেখেন স্রেফ বিরোধী শক্তির আখড়া হিসাবে, সেইমত তার উপর পুলিশ-প্রশাসন চাপিয়ে দেন, প্রত্যুত্তরে সেই দিকটাই বেশি করে ফুটে উঠবে, দেশের একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাস্থানের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক হবে বিপক্ষীয়।

তার বদলে তাকে দেখুন বিদ্যাকেন্দ্র হিসাবে। খোঁজ নিন, না হয় এসেই দেখে যান সেখানকার নানা দিকে প্রাগ্রসর গবেষণা, দেশি-বিদেশি অসংখ্য যোগ ও সম্মান, রাজনীতির বাইরে (ও অনেক বেশি মাত্রায়) ছাত্রছাত্রীদের অন্য হরেক চিন্তা ও বিনোদন। শেষ অবধি হয়তো আপনিও একমত হবেন, রাজনৈতিক যাদবপুরের যে জুজু পুলিশ-প্রশাসন নিজস্বার্থে গড়ে তুলেছে, তা গৌণ ও বহুলাংশে কাল্পনিক। জায়গাটার মুখ্য পরিচয় অন্যত্র, অন্য রূপে। এই খেয়ালি অস্বস্তিকর যাদবপুরকে বাগে আনার স্থূল তাত্‌ক্ষণিক উপায় পুলিশের লাঠি, সূক্ষ্ম ও সামগ্রিক উপায় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন। সেটাই আড়ালে-আবডালে অনেক দূর এগিয়েছে।

তিন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ক’দিন আগে এই পাতায় আবেদন জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেন না হয়ে ওঠে রাষ্ট্রশক্তির করদ রাজ্য। সেটা করতে পারলে অনেক আপদ বাঁচে ঠিকই, কিন্তু আমাদের উত্তরাধিকারের অবমাননা ও উত্তরাধিকারীদের বঞ্চনা করা হয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pst editorial sukanto choudhury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE