কে বলিল ভারত আর পাকিস্তান কেবল জাতীয় নিরাপত্তা বৈঠক ইত্যাদি লইয়া সমানে সমানে লড়ে? শুধু কূটনীতি নহে, সর্ব বিষয়েই তাহারা সমমনস্ক যুযুধান। এ যাহা করে, ও-ও তাহাই করে। দুটি দেশ আসলে শ্যামদেশীয় যমজ। বলিউডের ফিল্ম ‘ফ্যান্টম’ পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হইয়াছে, কেননা তাহা পাকিস্তান-বিরোধী, ‘সাম্প্রদায়িক’। মাস না ঘুরিতেই খবর, ভারতে একের পর এক জায়গায় তথ্যচিত্র ‘মুজফ্ফরনগর বাকি হ্যায়’-এর প্রদর্শন বন্ধ হইতেছে, লাঠিসোঁটা চলিতেছে, ধুয়া উঠিতেছে, ‘নিষিদ্ধ হউক’। এই উন্মত্ত ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার কারণ, ছবিটি নাকি হিন্দু-বিরোধী অর্থাৎ ভিন্ন অর্থে ‘সাম্প্রদায়িক’। প্রথমে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়। তাহার পর বিশ্বভারতী। দুই প্রাঙ্গণেই অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্য ছাত্ররা আসিয়া মারপিট ভাঙচুর সহযোগে ছবি প্রদর্শন বন্ধ করিয়াছে। বাকি সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার পেষণের মাধ্যমে নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার কায়েম করিয়াছে। অর্থাৎ মোটের উপর একই সূত্রে বাঁধা দুই দেশের সমাজ সংস্কৃতি, ক্রমশই স্পষ্ট। একটি সিনেমা দেখাইবার সাহস, সুযোগ বা ক্ষমতা যে দেশের বিদ্যায়তনের নাই, তাহার গণতন্ত্রের গৌরব পরিহাসের মতো শুনায় না কি?
বিশ্বভারতীর সংবাদটি সাম্প্রতিক ও অতীব উদ্বেগজনক। উদ্বেগ দুই কারণে। দিল্লিতে এবিভিপি-র দৌরাত্ম্য, হিন্দুত্ববাদীদের প্রতাপ প্রদর্শনের ঐতিহ্য সর্বজ্ঞাত। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি অনেকটা আলাদা বলিয়া ভাবিতেই আমরা পশ্চিমবঙ্গীয়রা অভ্যস্ত। ইহা কেবল বিভ্রান্তিকর বাঙালি ইগো বলিলে ভুল হইবে। ইহার মধ্যে নিহিত পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব ঐতিহাসিক গতিরেখা, যাহা উত্তর ভারতীয় রাজনীতি হইতে অনেকখানি দূরবর্তী। বাম ভাবাদর্শের স্ফুরণ ও শাসনের দীর্ঘ সময়কাল ছাড়াও আছে বাংলার প্রগতিমনস্ক যুক্তিবাদের গভীর ঐতিহ্য। সাধারণত তাই ধরিয়া লওয়া হয়, হিন্দুত্ববাদের নগ্ন দাপট প্রদর্শন উত্তর ভারতের মতো পশ্চিমবঙ্গে অত সহজ নয়। সম্প্রতি কালে বিজেপি-র প্রসার ও প্রচার বাড়িলেও এই ধারণা এখনও অনেকাংশে অক্ষুণ্ণ। অথচ ধারণাটি পরিবর্তনের সময় আসিয়াছে। রাজ্যের রাজনৈতিক আবহাওয়া পাল্টাইতেছে। সংখ্যাগুরুবাদী মানসিকতা হুড়মুড় করিয়া বাড়িতেছে। বিশ্বভারতীর ঘটনায় তাহারই আভাস।
অন্য উদ্বেগটি রাজনীতি-বিষয়ক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির দাপাদাপি ক্রমশ পশ্চিমবঙ্গের নিয়মিত দিনচর্যার অঙ্গ। বিশ্বভারতীর ঘটনার মধ্যে হিন্দুত্বের ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম্যের অপেক্ষা রাজনীতির দৌরাত্ম্য কোনও অংশে কম লক্ষণীয় নয়। হিন্দুত্বের ভাব বাড়িতেছে ঠিকই, কিন্তু আরও দ্রুত গতিতে বাড়িতেছে রাজনৈতিক ভাবে অতি-সক্রিয় এক-একটি অংশের তাড়নায় গোটা ক্যাম্পাসের সংকট। কোথাও সে সক্রিয়তা তৃণমূল-গোত্রীয়, কোথাও বিজেপি-গোত্রীয়। গোত্রভেদ থাকিলেও গুন্ডাভেদ নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইহারা রাজ্যব্যাপী বিপুল ও বিশাল গুন্ডা-প্রজন্মের প্রতিনিধি। এই বিভিন্ন গোত্রের জবরদস্তি একে অপরকে উৎসাহিত করে, অনুদার অগণতান্ত্রিক যূথশক্তির দাপট ক্রমশ বাড়িতে থাকিলে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়। এই উচ্ছৃঙ্খলতা এখনই কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপে দমন করা জরুরি। গুন্ডাগিরির ধ্বজাধারীদের কাছে স্পষ্ট বার্তা যাওয়া জরুরি যে এ রাজ্যের প্রশাসন ও তৎসূত্রে বৃহত্তর সমাজ ইহাদের আটকাইতে সক্ষম। সচেষ্টও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy