চিনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি সংবাদপত্র ‘লিয়াওনিং ডেলি’ তাহার কতিপয় সাংবাদিককে পাঠাইয়াছিল দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে, বহু ক্লাসে লুকাইয়া বসিয়া থাকিতে ও নজর করিতে, অধ্যাপকেরা পড়াইবার সময় কোনও চিন-বিরোধী কথা বলিতেছেন কি না। অভিযানে তাহারা জানিতে পারিয়াছে, বহু অধ্যাপক সত্যই এই কাজ করিতেছেন। কেহ মাও ত্সে তুং-কে প্রাচীন সম্রাটদের সহিত তুলনা করিতেছেন, অর্থাত্ তাঁহার মধ্যেও সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা আবিষ্কার করিতেছেন, কেহ চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নানাবিধ ব্যর্থতা লইয়া আলোচনা করিতেছেন। কেহ আবার পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণাগুলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সংবাদপত্রটি শিক্ষকদের প্রতি আর্জি রাখিয়াছে, নিজেদের পেশার গুরুত্ব ও মহত্ত্ব মনে রাখিয়া তাঁহারা যেন নিজ দেশ বিষয়ে হানিকর মতামত প্রচার না করেন। চিনের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে এই লইয়া তর্কাতর্কি চলিতেছে। গত বত্সর শি চিনফিং চিনের রাষ্ট্রপতি পদে বসিবার পরে, চিনা সরকার সমাজের সর্ব স্তরে, বিশেষত শিল্পী ও ধর্মগুরুদের প্রতি কড়া নজরদারি শুরু করিয়াছেন। কেহ কেহ অভিযোগ করিতেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের প্রতি নির্দেশ জারি করা হইয়াছে: কয়েকটি বিষয়ে কখনও মন্তব্য না করিতে, যেমন বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, সরকারি কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সম্পদ, বা সুশীল সমাজ। গত বত্সর এক অর্থনীতির অধ্যাপককে চাকুরি খোয়াইতে হয়, চিনে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলিবার কারণে। দুই অধ্যাপককে সতর্ক করা হইয়াছে, কারণ তাঁহারা ‘আরব বসন্ত’-এর গণ-অভুত্থান বা চিনের নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ন্যায় স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলিয়াছিলেন। আর এক অধ্যাপক ইলহাম তোহতি-কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হইয়াছে, কারণ তিনি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, সমগ্র জীবন সংখ্যালঘু মুসলিম উইগুর জনজাতির অধিকার লইয়া তীব্র কথা বলিয়া ও লিখিয়া আসিতেছেন।
দেশপ্রেম এক আশ্চর্য সুবিধাজনক আবেগ, যাহার দোহাই দিয়া চিন্তার অভ্যাসকে টুঁটি চাপিয়া ধরা যায়। দেশপ্রেম লইয়া গদগদ হইতে হইতে কর্তৃপক্ষ শেষে প্রচার করেন, দেশ যেমন চলিতেছে, তাহা লইয়া প্রশ্ন উত্থাপনই নিষিদ্ধ, কারণ তাহা দেশদ্রোহিতা। দেশের উন্নতির জন্যই যে সমালোচনা ও বিরোধিতার পরিসর সৃষ্টি করিতে হইবে এবং তাহাকে সম্মান করিতে হইবে, বারংবার সেই কটু কথাগুলি শুনিতে হইবে ও ধারাবাহিক আত্মসমীক্ষণের মধ্য দিয়া যাইতে হইবে, এই জরুরি কথাগুলিকে শাসক দল ভুলিয়া থাকিতে পারিলে, আত্মসন্তুষ্টির নিশ্চিন্ত শিবিরে ঢুকিয়া মহানন্দে রাজনীতি যাপন করা যায়। বিরোধীকে মুহূর্তে ‘দেশদ্রোহী’ দাগাইয়া দিতে পারিলে, জনসমর্থন লইয়া স্বৈরাচার কায়েম রাখিবার বিশেষ সুবিধা ঘটে। সকল একচ্ছত্রবাদী শাসকই শিক্ষককে ভয় পান, কারণ তিনি যুবসমাজের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন, তাহার পরিবর্তে শাসক চাহেন বেতনভুক বশংবদ; ছাত্রের পরিবর্তে অ-ভাবুক নিয়মপুত্তলি। কিন্তু যে কোনও শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষকের প্রকৃত কাজ: উত্তর বিতরণ নহে, প্রশ্ন উত্পাদন। ছাত্রের হৃদয়ে নিরন্তর প্রশ্ন করিবার অভ্যাসটি রোপণ করা। যাহা কিছু প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত, প্রথাসিদ্ধ, তাহাকেও নিজ যুক্তি ও বোধের নিক্তিতে তৌল করিয়া তবে গ্রহণ করিতে হইবে— এই শিক্ষাটি প্রদানই অধ্যাপকের প্রকৃত কর্ম। কেবল সিলেবাস মানিয়া পড়াইব, পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে বিশ্লেষণী অনুসন্ধানী কথা বলিব না, নিজ দেশ কাল লইয়া চর্চার পথ বন্ধ রাখিব, বা কেবল প্রতিষ্ঠানসিদ্ধ মতগুলির পুনরাবৃত্তি করিব, ইহা যদি শিক্ষাপ্রণালী হয়, তবে তাহা জ্ঞানের বিপরীত মার্গে শকট চালাইতেছে। দেশপ্রেম অন্য দেশের প্রতি ব্যাখ্যাহীন বিদ্বেষ ও নিজ দেশের প্রতি ব্যাখ্যাহীন প্রণতি জাগ্রত করিতে সদাব্যস্ত। তাই শিক্ষার চির-অন্বেষী সত্তাটিকে, তর্ক, দাবি, বিচারকে যাহারা হত্যা করিতে উত্সুক, দেশপ্রেমের গোদা তরবারি তাহাদের বড় প্রিয়।
য ত্ কি ঞ্চি ত্
এক পণ্ডিত বলেছিলেন, আত্মহত্যাই একমাত্র দার্শনিক প্রশ্ন। আর এক জন বলেছিলেন, আত্মহত্যা আর শহিদত্বের মধ্যে একটাই তফাত: প্রেস কভারেজ। এক বাঙালি মনীষী বলেছেন, প্রেস কভারেজওলা আত্মহত্যা করার সেরা স্থান গাড়ির বনেটের ওপর, গ্রীষ্মকালে চাদর জড়িয়ে। আর এক জন বলেছেন, উঁহু, বরং ঠিক ততগুলো বড়ি খাও, যাতে মরার কোনও চান্সই নেই। সাধারণ বাঙালি হাহাকার করছে, এই হট্টমেলা থেকে পালাতে আত্মহত্যা করব কী করে, মেট্রোর ভাড়া বেড়ে গেছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy