প্রশ্ন উঠিতেছে, আঠারো বছর বয়সের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক কী বার্তা দিতে চাহেন? শিক্ষামন্ত্রী বলিলেন, পড়াশোনায় মন দেওয়াই কাম্য। মুখ্যমন্ত্রী বলিলেন, বয়সোচিত দুঃসহ উদ্যমে তাহারা অন্যতর বিষয়ে মন দিলেই বা ক্ষতি কী! শিক্ষামন্ত্রী বলিলেন, শিক্ষক বা উপাচার্য কে হইবেন, তাহা লইয়া কলেজ-ছাত্রদের মাথা ঘামাইবার দরকার নাই। মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলিলেন না। রাজ্যের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকরণ ও দুর্বত্তায়নের প্রেক্ষিতে যখন শাসক দলের হইয়া তুলকালাম কুনাট্যে আত্মনিবেদিত ছাত্রদের সুযোগ পাইয়াও মুখ্যমন্ত্রী ভর্ৎসনা করিলেন না, দেখিয়া-শুনিয়া আঠারোর জয়গান গাহিলেন, তখন তিনি একটি বার্তা দিলেন। স্বভাবতই, শঙ্কুদেব পণ্ডা ও তাঁহার সঙ্গীরা প্রসন্ন, নিশ্চিন্ত। অধ্যক্ষ ও শিক্ষক নিগ্রহের নূতন নূতন ক্ষেত্র উন্মোচনে, কখনও টোকাটুকি, কখনও ছাত্রভর্তির দলতান্ত্রিক দাবিতে উদ্দীপিত। শিক্ষামন্ত্রীর মুখ-নিঃসৃত মৃদু সমালোচনা তাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর অসীম প্রশ্রয়ের ফুঁয়ে উড়াইয়া দিয়াছেন। এবং, ক্রমশই আরাবুল ইসলামের মতো আরও অনেক তরুণতর, নূতনতর সম্পদে দল সমৃদ্ধতর হইবে, সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকাইয়া শিক্ষামন্ত্রীও জনান্তিকে মুখ্যমন্ত্রীর সুবিবেচনার প্রশস্তি গাহিতেছেন।
বাস্তবিক, জনসমক্ষে যাহাই বলুন না কেন, জনান্তিকে যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ফারাক নেহাতই শূন্য, সে বিষয়ে সন্দেহ চলে না। নতুবা, কেন-ই বা এক জন দায়িত্ববান মন্ত্রী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়ভার বহিবার জন্য শিক্ষক-অধ্যক্ষদের করজোড়ে অনুরোধ করিবেন, যখন শাসক দলের ছাত্র-সংগঠনই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দাপাইয়া বেড়াইতেছে? রাজনীতিকরা রাজনীতি করিবেন, শিক্ষকরা রাজনীতি রুখিবেন, ইহাই কি মন্ত্রীর বক্তব্য? না কি, ছাত্ররা রাজনীতি করিবেন, এবং শিক্ষকরা সেই রাজনীতির সহায় হইয়া ‘শৃঙ্খলা’ভঙ্গের পরিস্থিতি নির্মূল করিবেন, ইহাই তাঁহার ইঙ্গিত? সংশয় হয়, দ্বিতীয়টিই সত্য, কেননা কোনও সভ্য সমাজে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ আটকাইবার দায়িত্ব তো সত্যই শিক্ষকসমাজের উপর বর্তাইতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক-অধ্যক্ষদের কপাল খারাপ। কখন কোন দিক হইতে রাজনীতির অভিশাপ তাঁহাদের উপর বর্ষিত হইবে ভাবিয়া তাঁহারা কাঁটা হইয়া থাকেন। এ বার তদুপরি গুন্ডামি সামলাইবার মনোবল, এমনকী পেশিবলও নাকি তাঁহাদেরই দেখাইবার কথা।
সর্বাধিক দুশ্চিন্তা ইহাই যে, দায় বহন করিতে বলা আর দায় চাপানোর মধ্যে তফাতটি নেহাতই সূক্ষ্ম। তৃণমূল সংগঠনের আয়োজনে একের পর এক শিক্ষক-নিগ্রহ চলিবে, এবং তাহার দায়িত্ব সংগঠন, দলনেতা কিংবা সরকারি মন্ত্রী কেহই লইবেন না, এই তবে প্রশাসনের অবস্থান। এইখানেই তৃণমূল সরকার তাহার পূর্ববর্তী সরকারের পদচিহ্ন বহুলাংশে অতিক্রম করিয়া যায়। বামফ্রন্ট সরকার দলতন্ত্রের শক্তপোক্ত অধিষ্ঠান গড়িয়াছিল, শিক্ষাক্ষেত্রে ‘অনিলায়ন’ নামক একটি ধারা তৈরি করিয়াছিল। কিন্তু দলতান্ত্রিক হামলা প্রতিরোধের সকল দায় সাধারণ নাগরিকের উপর, এমন কথা সর্বসমক্ষে উচ্চারণের স্পর্ধা দেখায় নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবর্তন আনেন নাই, উত্তরাধিকারের বৈপ্লবিক অবনমন আনিয়াছেন। তাঁহার সৌজন্যে আজ শঙ্কুদেবরা শিক্ষক-অধ্যক্ষদের গলাধাক্কার ঢালাও অধিকার পাইয়াছেন, দলতন্ত্রের প্রতাপ বে-আব্রু, অশালীন হইয়াছে, গুন্ডা-মন্ত্রী-নির্ভরতার দুষ্টচক্র সমস্ত রকম লুকোছাপা ছাড়িয়া সরকারি সিলমোহর পাইয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী কথায় কথায় গত চৌত্রিশ বছরের অপশাসনের কথা বলেন। তিনি নিশ্চিত থাকিতে পারেন, ভাবী ইতিহাস তাঁহার সর্বব্যাপী গুন্ডাশাসনের কথা বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত হিসাবে মনে রাখিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy