Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

দায়িত্ব বুঝিয়া লউন

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করিলে পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’-র ধুয়া তুলিবেন, তাহাই দস্তুর। সম্ভবত নিয়মও। বামপন্থীরা তুলিতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তুলিয়াছেন। তবে, অভ্যাসের দাসত্ব বরাবরই বিপজ্জনক। এই দফায় যেমন মমতাদেবী খেয়াল করেন নাই, অরুণ জেটলি তাঁহার হাতে বিপুল ক্ষমতা তুলিয়া দিয়াছেন।

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করিলে পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’-র ধুয়া তুলিবেন, তাহাই দস্তুর। সম্ভবত নিয়মও। বামপন্থীরা তুলিতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তুলিয়াছেন। তবে, অভ্যাসের দাসত্ব বরাবরই বিপজ্জনক। এই দফায় যেমন মমতাদেবী খেয়াল করেন নাই, অরুণ জেটলি তাঁহার হাতে বিপুল ক্ষমতা তুলিয়া দিয়াছেন। শুধু তাঁহার হাতেই নহে, সব রাজ্যের হাতে। যোজনা খাতে বরাদ্দ প্রায় তিন গুণ বাড়িয়াছে। এবং, আগের জমানায় কেন্দ্রীয় সাহায্য যেমন বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ হইয়া রাজ্যের হাতে পৌঁছাইত, সেই ব্যবস্থাটিও বদলাইয়া গিয়াছে। অতঃপর রাজ্যের হাতে সম্মিলিত বরাদ্দ পৌঁছাইবে। যে রাজ্যের যে খাতে অর্থ প্রয়োজন, এই টাকা সেই খাতেই ব্যবহার করা যাইবে। সত্য, পরিকল্পনাটি অরুণ জেটলির নিজস্ব নহে। পি চিদম্বরম তাঁহার শেষ বাজেটে এই পথের সূচনা করিয়াছিলেন। কিন্তু শাসনকালের দশ বৎসর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া আর্থিক কেন্দ্রিকতার চূড়ান্ত করিবার পর বিদায়বেলায় এই সিদ্ধান্ত তাঁহাদের সরকারের পাপ লাঘব করিতে পারে নাই। বরং, নরেন্দ্র মোদী যে সহযোগিতাভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার কথা বলেন, অরুণ জেটলির ঘোষণা তাহার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ। বিভিন্ন রাজ্যে উন্নয়নের গতিপথ ভিন্ন, তাহাদের প্রয়োজনগুলিও বিবিধ। ফলে, রাজ্যগুলির হাতে এই আর্থিক স্বাধীনতা অতি জরুরি ছিল। ইহা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামোর শর্তও বটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সরব সমর্থক। কাজেই, জেটলির ঘোষণায় তিনি সন্তোষ জ্ঞাপন করিতে পারিতেন। অবশ্য, তাহার জন্য বাজেটটি পড়িতে হইত।

স্বাধীনতার ধারণাটির সহিত দায়িত্বের সম্পর্ক অতি নিবিড়। অরুণ জেটলির প্রস্তাব রাজ্য সরকারগুলির হাতে অ-পূর্ব ক্ষমতা তুলিয়া দিবে। কিন্তু, তাহাতে রাজ্যের উন্নয়ন আদৌ সাধিত হইবে কি না, তাহা নির্ভর করিবে রাজ্য সরকারের দায়িত্ববোধের উপর। কেন্দ্রীয় তহবিল আসিলে সেই টাকায় স্কুল নির্মাণ হইবে, হাসপাতালের উন্নতিসাধন হইবে নাকি ক্লাবে-ক্লাবে মোচ্ছব ভাতা বিলি করা হইবে, ইমামদের অধিকতর মাসোহারার ব্যবস্থা হইবে, বা নিদেনপক্ষে সরকারি কর্মীদের বেতন দেওয়া হইবে, তাহাই মূল প্রশ্ন। ভারতে এমন বহু রাজ্য আছে, যেখানে এই নূতন ব্যবস্থা উন্নয়নের জোয়ার আনিতে পারে। আবার, পশ্চিমবঙ্গও আছে। জেটলি উন্নয়নের ‘ম্যানেজমেন্ট’-টি রাজ্য সরকারগুলির স্কন্ধে চালান করিয়া দিলেন। রাজ্য সরকারগুলির উপর কেন্দ্রের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকিবে না, তাহা নহে। কোন খাতে কত বরাদ্দ প্রয়োজন, তাহা যেমন জানাইতে হইবে, তেমনই সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির হাতে টাকা পৌঁছাইতেছে কি না, তাহাও কেন্দ্র নজরে রাখিবে। কিন্তু, দৈনন্দিন নিয়ন্ত্রণ আর থাকিল না। কোন রাজ্য কোন খাতে কতখানি উন্নতি করিবে, তাহা মূলত সেই রাজ্যের শাসকদের উপর নির্ভরশীল হইল। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এই পরীক্ষায় বসিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তুত তো?

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল ধারণাটির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পাশাপাশি জেটলির এই সিদ্ধান্ত আরও একটি জরুরি কাজ করিতে সক্ষম হইতে পারে। এত দিন অবধি কেন্দ্র হইতে রাজ্যের হাতে আর্থিক সাহায্য পৌঁছাইবার পথটি সংসদ মার্গ-এর যোজনা ভবন হইয়া যাইত। নূতন ব্যবস্থায় যেহেতু প্রকল্পওয়াড়ি টাকা পাঠাইবার প্রয়োজনীয়তা নাই, প্রকল্পের অগ্রগতি বিচার করিবার দায়িত্বও আর কেন্দ্রীয় সরকারের নহে, ফলে যোজনা কমিশনের ভূমিকাও সম্ভবত হ্রাস পাইবে। রাজ্য সরকারগুলি সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পাওনাগণ্ডা বুঝিয়া লইতে পারিবে। যোজনা কমিশনের যে আর প্রয়োজন নাই, কথাটি নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই প্রকারান্তরে বুঝাইয়া দিয়াছেন। অরুণ জেটলির সিদ্ধান্তটি সে দিকে আরও এক কদম আগাইয়া গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE